প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

স্বপ্নের আমেরিকা থেকে ফেরত আসা বিয়ানীবাজারের ৫ তরুণের দুঃস্বপ্নের গল্প

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৭, ২০২৫, ০৭:১৪ অপরাহ্ণ
স্বপ্নের আমেরিকা থেকে ফেরত আসা বিয়ানীবাজারের ৫ তরুণের দুঃস্বপ্নের গল্প

Manual2 Ad Code

ফাইল ছবি/

 

স্টাফ রিপোর্টার:

Manual5 Ad Code

ফাহিম আহমদ, ২৮ বছর বয়সী বিয়ানীবাজারের এই যুবক দুই বছর আগে উন্নত জীবনের খোঁজে যুক্তরাষ্ট্র যেতে ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেন। কিন্তু সেই উন্নত জীবনের খোঁজ মেলেনি।

দুই পায়ে লোহার বেড়ি। কোমরে মোটা শিকল বাঁধা। দুই হাতের হাতকড়া সেই শিকলের সঙ্গেই আটকানো— এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়োজাহাজে তোলা হয় তাকে।

এ অবস্থায় টানা ৬০ ঘণ্টা কাটানোর পর উড়োজাহাজটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উড়োজাহাজ থেকে নামার কয়েক মিনিট আগে তাদের হাতকড়া ও শিকল খোলা হয়।

সম্প্রতি তিনি ৩৮ জনের সঙ্গে একটি বিশেষ মার্কিন সামরিক ফ্লাইটে ঢাকা হয়ে বাড়ি ফিরেছেন সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে। ফাহিম বলেন, ‘আমি বাবার সব সঞ্চয় খরচ করেছি এবং আমাদের জমি বিক্রি করেছি। এখন জানি না কী করব।’

তিনি জানান, কানাডায় থাকা দুজনের ওপর বিশ্বাস ছিল। তারা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে দেওয়া এবং ছয় মাসের মধ্যে গ্রিন কার্ড পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

Manual3 Ad Code

এই তরুণের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর। তাকে প্রথমে কাতার, পরে কানাডা হয়ে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হয়।

সেদেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দুদিনের মধ্যে তিনি মুক্তি পান। ছয় মাস পর আবার গ্রেপ্তার হন। এরপর তিন মাস একটি ডিটেনশন সেন্টারে ছিলেন। দেশে ফেরার বর্ণনা দিয়ে ফাহিম বলেন, ‘আমাদের হাতকড়া-বেড়ি-শিকল পরানো হয়। সারাদিন ওই অবস্থায় রাখার পরে রাত ৯টার দিকে আমাদের উড়োজাহাজে তোলে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমরা ঢাকায় পৌঁছাই। এই পুরোটা সময় তো একই অবস্থায় ছিলাম।’

বিয়ানীবাজারের অপর তরুণ সিদ্দিকুর রহমান একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তিনি জানান, তিনি এক আত্মীয়ের সঙ্গে ২৮ লাখ টাকার চুক্তি করেছিলেন। পরে যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছানোর জন্য আরও ৩ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন।

Manual1 Ad Code

সিদ্দিক ব্রাজিল, পেরু ও বলিভিয়ার মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে শেষ পর্যন্ত কলম্বিয়ায় পৌঁছান। সেখানে তাকে অন্যদের সঙ্গে ২৮ দিন ধরে একটি বাড়িতে রাখা হয়। খাবার ছিল সামান্য। ভালো পরিবেশ চাইলে দালালরা তাদের অন্যত্র নিয়ে যায়।

গুয়াতেমালায় তাদের একটি কক্ষে আটকে পেটানো হয় এবং ক্ষুধার্ত রাখা হয়। তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। ৪২ দিন পর দালালরা হুমকি দেয়, তারা যদি চলে না যায় তাহলে তাদের গুলি করে মারা হবে।

অর্থের বিনিময়ে সিদ্দিকের সঙ্গে আরও পাঁচজন বাংলাদেশি মেক্সিকান দালালের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি করে। ওই দালাল তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ছয় লাখ করে টাকা নেয়।

মেক্সিকোতে পৌঁছানোর পর তাদের আরেকটি দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর তারা মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

সিদ্দিক ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন মার্কিন কারাগারে ছিলেন। ২৮ নভেম্বর তিনি শূন্য হাতে ফিরে আসেন। তার প্রায় ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি দেশে দালালরা স্থানীয় এজেন্টদের ছবি ও নম্বর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাত। প্রতিটি ধাপেই নতুন করে টাকা দিতে হতো।’ তিনি আরো বলেন, ‘তিন বেলা শুকনো খাবার দিতো। হাতে হাতকড়া অবস্থায় খেতে হয়েছে। দীর্ঘসময় হাতকড়া পরে থাকায় হাতে ঘা হয়ে গেছে।’

ফাহিম ও সিদ্দিক দুজনই জানান, তারা কেবল একটি উন্নত ভবিষ্যৎ চেয়েছিলেন। দেশে ফেরত পাঠানোর আগে তাদের ভয়, ক্ষুধা ও কারাবাসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।

সিদ্দিক বলেন, আমরা তাদের ওপর আস্থা রেখেছিলাম। এখন সব হারিয়েছি। আমাদের টাকা, সময়, আশা, সব শেষ। আর কেউ যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়েন।

তাদের সঙ্গে ফেরা বেশিরভাগ যাত্রী ৩৫ লাখ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। অনেকেই তাদের শেষ জমিটুকুও বিক্রি করে যাত্রার খরচ জোগাড় করেন।

ঢাকায় অবতরণের পর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্র্যাক তাদের পরিবহন সুবিধা ও জরুরি সহায়তা দেয়।

Manual6 Ad Code

তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আসা বিয়ানীবাজারের ৫ তরুণ (পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক) ব্রাজিলে বৈধভাবে ভ্রমণ করেন, তারপর মেক্সিকোর পথে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার আবেদন দাখিলের পর তাদের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

 

ফেরত আসা স্বপন বলেন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবৈধ অভিবাসীদের নির্বাসন বাড়ছে। শরণার্থী ক্যাম্পে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। টয়লেটে যাওয়ার সময় তারা (পুলিশ) জিজ্ঞাসা করছিল ১ নম্বর (প্রস্রাব) নাকি ২ নম্বর (পায়খানা)। দুই নম্বর হলে এক হাত খুলে দিয়েছিল। না হলে ওই অবস্থায় টয়লেটে যেতে হয়।

প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা খরচ করে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় যান আরেক তরুণ রিফাত আহমদ । উন্নত জীবনের আশায় অবৈধভাবে ৩ দেশ পেরিয়ে প্রবেশ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে পুলিশের হাতে আটক হন তিনি।

আমেরিকায় অবৈধ অনুপ্রবেশ করা বিয়ানীবাজারের রিফাত বলেন, ‘বলিভিয়া হয়ে আমি ব্রাজিল গিয়েছিলাম। ব্রাজিল থেকে মেক্সিকোতে। মেক্সিকো বর্ডার পাড় হওয়ার সময়ই আটক করা হয় আমাকে । তিনি সবমিলিয়ে ৫২ লাখ টাকা খুইয়েছেন। অথচ তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশা ফেরা মো: শাহজাহান বলেন, ৩৫ লাখ টাকা খরচ করে আমেরিকা গিয়েছিলাম। অথচ মার্কিন আইনজীবীরা আমাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েও কোনো সাহায্য করেনি। তিনি বলেন, ‘কত অমানবিকভাবে আমাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে সে কথা এখন জিজ্ঞাস করে কী করবেন? কারও ক্ষমতা নেই আমেরিকার এই মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার।’

ফিরে আসা তরুণরা শারীরিকভাবে অসুস্থ ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার অবৈধভাবে বসবাসরত অভিবাসীদের জন্য নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার একটি সুযোগ দেয় বলেও মার্কিন দূতাবাস সূত্র জানায়। এক বিজ্ঞপ্তিতে যারা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাস করছেন তাদের স্বেচ্ছায় ফিরে আসার সুযোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। এতে শুধু তাদের অভিবাসন সমস্যা মিটবে না, বরং তারা সম্মানের সঙ্গে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারবেন।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code