প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৬শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

কান কথা থেকে গুজব ছড়াচ্ছে

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ২২, ২০২৫, ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ
কান কথা থেকে গুজব ছড়াচ্ছে

Manual7 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

ঘটনা ঘটেছে এক রকম, কিন্তু উপস্থাপনা ভিন্ন। শোনা কথাই হয়ে যাচ্ছে অকাট্য সত্য। তিল তাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। কোনোরকম বাছ-বিচার ছাড়াই শোনা কথা শেয়ার করছে একে অপরের সঙ্গে। আর এভাবেই কানকথা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে গুজব। শব্দটি ছোট হলেও এর পরিধি ও পরিণতি অত্যন্ত ব্যাপক ও ভয়াবহ।

Manual1 Ad Code

সমাজে গুজব নতুন কিছু নয়। এটি একটি প্রাচীন সামাজিক ব্যাধি, যা আগেও ছিল, এখনও আছে। শুধু এর ধরনটা বদলেছে। আগে গুজব একটি গণ্ডির মধ্যে থাকত, ছড়াতে সময় লাগত। এর উৎপত্তিস্থল ছিল কুসংস্কার কিংবা মিথ্যা তথ্য, যা যুগের পর যুগ মানুষ কথার ওপর ভর করে চলত। কিন্ত বিশ্বায়নের এ যুগে গুজবের উৎস, রং এবং ছড়ানোর ধরনও বদলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে অপতথ্য। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ডিপফেক ভিডিও, যা খালি চোখে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, ঘটনাটি মিথ্যা বা গুজব।

গুজবের প্রকৃতি দ্রুত বদলে গেলেও মানুষের চিন্তা পরিবর্তন তেমন হয়নি। ফলে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবকিছু অবাধে শেয়ার করছে অনেকেই। এর মধ্যে কেউ জেনে বুঝে শেয়ার করছে, আবার কেউ না বুঝেই ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফলে দেশ ও সমাজে হানাহানি ও বিশৃঙ্খলার হার অনেকটাই বেড়েছে।

 

বাংলাদেশে ভুয়া তথ্য ছড়াছড়ির হার বেড়েছে

ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় রেকর্ডসংখ্যক অর্থাৎ ২ হাজার ৯১৯টি ভুল তথ্য বা গুজব শনাক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে শনাক্ত হয়েছিল ১৯১৫টি ভুল তথ্য। এক বছরের ব্যবধানে রিউমর স্ক্যানার প্রায় ৫২ শতাংশ হারে ভুল তথ্য বৃদ্ধির কথা বলছে। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত আর ১৬০টি ভুল তথ্য বা গুজব শনাক্তের কথা বলছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২৪ সালে রিউমর স্ক্যানারে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে পুরোপুরি মিথ্যা বা ভুয়া ঘটনাসংবলিত ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ২০২৮টি। এ ছাড়া বিভ্রান্তিকর রেটিং দেওয়া হয়েছে ৫৩৩টি। বিকৃত রেটিং পেয়েছে ৩০৮টি, অধিকাংশই মিথ্যা এমন রেটিং পেয়েছে তিনটি। শুধু তাই নয়, সার্কাজম বা কৌতুক হিসেবে হাস্যরসাত্মক ঘটনাকে বাস্তব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে ৩১টি। যাচাইয়ের পর অর্ধেক সত্যতা পাওয়া গেছে এমন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে মাত্র দুটি।

Manual2 Ad Code

ভুয়া তথ্য কারা ছড়ায়, কেন ছড়ায়

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটি কারণে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও দেশগত কারণে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বিরোধী দলের কিছু পেলে কিংবা ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে মিলে গেলেই কোনো যাচাই-ছাড়াই তারা গুজব ছড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়ায় আবার কেউ না বুঝে ছড়ায়। আবার অনেকে কোনো ইনফ্লুয়েন্সার বা সেলিব্রিটি দ্বারা প্রভাবিত হয়েও গুজব ছড়ায়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেও ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত প্রতিবেদনেও প্রায়ই ভুল তথ্য ছড়ানো হয়। গত বছর গণমাধ্যমে ১৫১টি ভুল তথ্য ছড়ানোর তথ্য পাওয়া গেছে।

Manual5 Ad Code

একটা ভুয়া তথ্য যেভাবে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে

Manual3 Ad Code

সত্য তথ্য যতটা না দ্রুত ছড়ায় তারচেয়ে বেশি দ্রুত ছড়ায় ভুয়া তথ্য। গত আগস্ট মাস থেকে মুসলমানরা এক হিন্দু বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যার পর মূর্তির সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে দাবি করা দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধান বলছে, প্রচারিত ভিডিওগুলো বাংলাদেশে মুসলিমদের দ্বারা একজন হিন্দু বৃদ্ধকে হত্যা করে মূর্তির সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখার নয়। প্রকৃতপক্ষে, এগুলো গত আগস্টে ঝিনাইদহের পোড়াহাটী ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরন নামের একজন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যার পর পায়রা চত্বরের মূর্তির সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটানোর দৃশ্য। অথচ রাজনৈতিক কারণে মুসলিম চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরনকে হত্যার ভিডিও বাংলাদেশে হিন্দু বৃদ্ধকে পিটিয়ে মূর্তির সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়ার দাবিতে ভারতে প্রচার করা হয়েছে।

এ ছাড়া গত ১ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু নারীকে মারধরের দৃশ্য বাংলাদেশের ঘটনা দাবিতে অপপ্রচার করা হয়। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশি হিন্দু মাকে ইসলামপন্থিরা আক্রমণ করেছে তার পুত্র একজন মুসলিম নারীকে তাদের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করায়’ শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও এক্সে প্রচার করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওর নারী বাংলাদেশ নন, বরং তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের বাসিন্দা। প্রকৃতপক্ষে, আহত নারীর ছেলে প্রেমের সম্পর্কের জেরে একজন মুসলিম নারীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই পরিবারের লোকজন ছেলেটির বাড়িতে হামলা চালিয়ে ছেলের মাকে আহত করেন। সুতরাং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু নারীকে মারধরের দৃশ্যকে বাংলাদেশের ঘটনা দাবি করে প্রচার করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এভাবেই ধর্মীয় ও দেশগত রাজনীতির কারণে দ্রুতই গুজবের ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে।

ভুয়া তথ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়ে সমাজে

সম্প্রতি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এক তরুণীকে টার্গেট করে অপপ্রচার চালানো হয়। প্রথম আলোর নাম ও লোগো ব্যবহার করে ফারিয়া নামের এক তরুণীর নাম ও ছবি ব্যবহার করে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘পেটের ভেতরে ইয়াবা পাচার, চাঁদপুরে ছাত্র-ইউনিয়ন নেত্রী আটক’। এর সঙ্গে এই ভুয়া ফটোকার্ডটি প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হয় ১৩ নভেম্বর। তবে প্রথম আলোর কোনো প্ল্যাটফর্মে ওই তারিখে এমন কোনো ফটোকার্ড প্রকাশের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ফটোকার্ডটির ফন্ট ও ডিজাইনের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য প্রথম আলোর আসল ফটোকার্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এ ছাড়া সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাসসুমের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নুসরাত তাবাসসুমের আলোচিত ছবিটি আসল নয় বরং, ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে আলোচিত ছবিটি তৈরি করা হয়েছে।

কেউ ভুয়া তথ্যের শিকার হলে যেসব পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়

গত বছরের ১১ নভেম্বর দুপুরে বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার জয়পুরপাড়া এলাকায় ‘আজিজিয়া মঞ্জিল’ নামে চার তলা একটি বাড়ি থেকে সালমা খাতুনকে (৫০) হত্যার পর ফ্রিজে রাখার অভিযোগে তার ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমানকে (১৯) গ্রেফতার করে র‌্যাব। তবে পুলিশের তদন্তে ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে।

‘হাত খরচের টাকা না পেয়ে মাকে তার ছেলে হত্যা করে মরদেহ ফ্রিজে রেখেছিল’ বলে র‌্যাব যে তথ্য দেয়, রিমান্ডে তার উল্টো তথ্য দেন সাদ। সেই সঙ্গে ফাঁসানোর কথা বলেন তিনি। ওই তথ্যের বরাত দিয়ে ঘটনায় জড়িত তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ জানায়, ছেলে নয়, বাড়ির ভাড়াটিয়ারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে প্রমাণের আগে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। ভুয়া তথ্যের কারণে অনেক কিছু সামাল দিতে হয়েছে সাদকে।

সাদের পিতা মো. আজিজুর রহমার সময়ের আলোকে বলেন, মূলত গুজব থেকেই র‌্যাবের সন্দেহ হয়েছিল। ফলে আমার ছেলে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছিল তারাই গুজব ছড়িয়ে ঘটনাটা এমন করেছে। ফলে শুরুতে আমরা সামাজিকভাবে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ছিলাম। একদিকে মাকে হারানোর শোক অন্যদিকে নিজেই মাকে হত্যার আসামি এমন পরিস্থিতিতে আমার ছেলে বারবার সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল। আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি যে, ছেলে এমনটা করতে পারে। আল্লাহ ন্যায়বিচার করেছে, সত্য উদঘাটন হয়েছে। সেদিনের পর থেকে আমার ছেলে অনেকটা চুপসে গেছে। সে এখনও ট্রমার মধ্যে আছে। এখন কোথাও আর একা ছাড়ি না। তবে আল্লাহর রহমতে আমার ছেলে এখন ভালো আছে। সবাই দোয়া করবেন।

শুধু সাদই নয়, শোনা কথা কিংবা গুজব থেকে অনেকের জীবন বরবাদ করার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। যাচাইয়ের মনোভাব না থাকায় ডালপালা ছড়িয়েছে গুজব।

এসব ঘটনা এড়াতে কিংবা ভুল তথ্য থেকে রক্ষা পেতে তথ্য যাচাইয়ের মানসিকতা থাকা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারের হেড অব অপারেশন সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, ভুল তথ্য থেকে বাঁচতে মানুষকে প্রযুক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে মানুষকে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাক্ষরতা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। কনফার্মেশন বায়াস বা নিশ্চিতকরণের জন্য পক্ষপাতিত্বের বৃত্ত থেকে নেটিজেনদের বের হতে হবে।

তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে ভুল তথ্য যাচাইয়ের প্রাথমিক কৌশলগুলো সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জানা থাকা জরুরি।

প্রথমত, তথ্যটি অতিরঞ্জিত মনে হলে সেটি সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ হতে হবে। দ্বিতীয়ত, তথ্যটি কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এসেছে কি না তা দেখতে হবে। তথ্যের কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র না পাওয়া গেলে তথ্য যাচাই বা ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলোতে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে কিনা তা দেখা যেতে পারে। সিদ্ধান্ত না পাওয়া গেলে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলোতে যোগাযোগ করে নেটিজেনরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code