প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

শিক্ষাব্যবস্থায় বাড়ছে বেকার

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ১৯, ২০২৪, ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ
শিক্ষাব্যবস্থায় বাড়ছে বেকার

Manual3 Ad Code

 

Manual2 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষা শেষে দেশে নতুন করে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে ৫ লাখ শিক্ষিত বেকার। ১০ বছরের মাধ্যমিক ও দুই বছরের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে লেখাপড়া করেও বলতে গেলে তারা অনুৎপাদনশীল। দেশের অর্থনীতিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারছেন না। শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি দেশে শিক্ষিত বেকার তৈরি করছে। আর এ জন্য দেশের পুথিগত শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন তারা।

শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বৃত্তিমূলক জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। সে কারণে বাস্তব জীবনে পুথিগত জ্ঞান কাজে আসে না। অষ্টম শ্রেণি শেষে বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর চিন্তাভাবনা থাকলেও তা করা যায়নি। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে কারিগরি শিক্ষা জনপ্রিয় করা যায়নি। অভিভাবকরা সন্তানকে শিক্ষিত করা মানে ‘বিএ’, ‘এমএ’ পাস করাকে বুঝে থাকেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষায় দেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ লেখাপড়া করে। তা ৩০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা থাকলেও কারিগরি শিক্ষায় অনীহা রয়েছে।

বুধবার প্রকাশিত দেশের নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি), মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, তাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। ১১টি বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ জন। আর ফেল করেছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৪৯ জন। দেখা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিকে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে সিংহভাগ ঝরে পড়ে। আর ফেল করা শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি অংশ পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন কারণে উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় অধিভুক্ত কোনো কলেজে ভর্তি হয় না। এই পরিসংখ্যানে এ বছর পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসির পর উচ্চশিক্ষায় আর যুক্ত থাকবে না।

আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এইচএসসির পর কয়েক বছর বেকার থাকার পর ‘ছাত্র’ ভিসায় কিছু শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমায়। তবে তারা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাওয়ায় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ ছাড়া অদক্ষ শ্রমিক হওয়ায় দেশ অধিক হারে রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হয়।

শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্যক্রম পুথিগত বিদ্যানির্ভর। আর এ কারণেই ঝরে পড়া ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ না পাওয়ারা দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে পারে না। বরং বেকার হয়ে দেশে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে।

লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীর মধ্যে ৪৭ জন বেকার। ভারত ও পাকিস্তানে প্রতি ১০ জন শিক্ষিত তরুণের তিনজন বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। তখন সংস্থাটি আভাস দেয়, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯.৪০ শতাংশ হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বেকারদের মধ্যে চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের হার ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। নারী চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৩১ শতাংশ। এরপরই আছে উচ্চ মাধ্যমিক ডিগ্রিধারীরা। তাদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০টি সর্বাধিক বেকারত্বের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বাদশ। বিবিএসের তথ্যে আরও দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করা বেকারের হার ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মাধ্যমিক শেষ করা বেকার ২ দশমিক ৪২ শতাংশ। প্রাথমিক শেষ করা বেকারের হার ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অন্য কোনো মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করা ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

Manual7 Ad Code

কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাস করাদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা কেমন; এ সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা সময়ের আলোকে জানান, কারিগরি শিক্ষা নেওয়া শিক্ষার্থীরা কেউ আসলে শেষ পর্যন্ত বেকার থাকেন না। চাকরি না পেলেও নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকেন তারা।

Manual6 Ad Code

এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা বলছে, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনও অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে কিছু করছেন। শিক্ষা অর্জন শেষে বেকার জীবনে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রায়োগিক জ্ঞান না থাকা।

উচ্চশিক্ষিত হয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশ দেশের তরুণ সমাজ। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না। গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণের।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা ও পরবর্তী ধাপে কর্মমুখী শিক্ষার কথা উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষায় নজর দিলেও তা অপ্রতুল। সরকারের পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। রাশেদা কে চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে সন্তানকে বিএ, এমএ পাস করাতে হবে। কিন্তু দেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষার চাহিদা বাড়ছে। তবে শিক্ষা বাজেটে সবচেয়ে কম বরাদ্দ বৃত্তিমূলক শিক্ষায়। তিনি বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় জনশক্তি দেশে ও দেশের বাইরে অদক্ষ হয়ে থাকছে। এরা দেশের জন্য শিক্ষিত বেকার হিসেবে বোঝা বাড়াচ্ছে।

Manual7 Ad Code

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রায়োগিক জ্ঞানের প্রতিফলন নেই। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানো দরকার। অন্য দেশেরটা কপি করে কোনো ভালো কিছু হবে না।

এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আমানুল্লাহ বলেন, দেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা লাগবে। এটি কখনো হয়নি। তিনি বলেন, পুথিগত শিক্ষায় সার্টিফিকেটধারীর সংখ্যা বাড়ছে। এর সঙ্গে প্রতি বছর বেকারের সংখ্যা দেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। প্রায়োগিক জ্ঞানে কারিগরি শিক্ষায় সন্তানদের গড়ে তোলা গেলে তারা জনশক্তিতে রূপ নিত।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code