প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

রাশিয়ায় যোদ্ধা পাচারে ৬৭ চক্র

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫, ০১:০০ অপরাহ্ণ
রাশিয়ায় যোদ্ধা পাচারে ৬৭ চক্র

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

জীবন ও জীবিকায় কিছুটা সচ্ছলতা ফেরানোর দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে ইউরোপের দেশ সাইপ্রাসের উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন জাফর। কিন্তু দেশ ছাড়ার পর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাই হয়ে কয়েক হাত বদলের পর ২০ লাখ টাকায় তাকে রাশিয়ার একটি মানব পাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয় দালালচক্র। সেখানে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। এতে রাজি না হলেই নেমে আসত ভাষায় অবর্ণনীয় নির্যাতনের খড়গ। যশোর সদরের চাচরা ইউনিয়নের এই যুবক এখন প্রতিটি মুহূর্ত পার করছেন মৃত্যুভয়কে সঙ্গী করে। স্থানীয় দালাল ও রাজধানী ঢাকার একটি মানব পাচার চক্রের ফাঁদে পড়ে নিজের জীবন তো বটেই, একই সঙ্গে তার পুরো পরিবারকে ফেলেছেন অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজের একটি ছবি তুলে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে জীবন নিয়ে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন জাফর।

 

Manual4 Ad Code

ছেলের এমন দুরবস্থার কথা জানতে পেরে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েছেন মা হাসিনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে রাশিয়া-ইউক্রেনে যুদ্ধ করবে কেন? সে তো কাজ করে জীবন বদলাতে গিয়েছিল। বিদেশে কেউ যুদ্ধ করতে যায় না, আমার ছেলেও যায়নি। আমরা গরিব মানুষ, কাজ করে অর্থ আয় করে জীবন চালাতে চাইছিলাম। কিন্তু এ কী হলো আমার সন্তানের সঙ্গে!’

অন্যদিকে দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চোখে অন্ধকার দেখছেন জাফরের স্ত্রী খাদিজা খাতুন। তিনি বলেন, ‘২০ দিন আগে আমার সঙ্গে তার (জাফরের) কথা হয়েছে ফোনে। সে শুধু একটা কথাই বারবার বলতেছিল, আমি যেন সন্তানদের দেখে রাখি। তার কণ্ঠ শোনার পর থেকে বুকের ভেতর এত কষ্ট হচ্ছে যে, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমরা চাই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। এটা সরকার কীভাবে আনবে আমরা জানি না। তাদের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন।’

উন্নত জীবনের আশায় নাটোর থেকে বিদেশে পাড়ি জমান রহমত আলী ও হুমায়ুন কবির। তারাও একই কায়দায় দালালদের খপ্পরে পড়ে বিক্রি হয়ে যান রাশিয়ায়। রহমত ও হুমায়ুন সম্পর্কে শ্যালক দুলাভাই। এরই মধ্যে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের মাঠে গিয়ে ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন হুমায়ুন। যে খবর বাড়িতে জানিয়েছেন রহমত আলী। তিনি এখনো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। নিজের দুরবস্থার কথা জানিয়ে নিয়মিত বিরতিতে বাড়িতে মোবাইল ফোনে কল করে তাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে কান্নাকাটি করছেন। রহমত ও হুমায়ুনের এমন পরিণতিতে শোক ও দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েছেন তাদের পরিবারের সব সদস্য। তারা কেউই কথা বলার মতো স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকায় দেশ রূপান্তরের কথা হয় তাদের প্রতিবেশী শিহাবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে তো সবাই ইতিমধ্যে জেনেই গেছে। এখন যেটা সমস্যা সেটা হলো নিহতের লাশ দেশে আনা ও যে সেখানে বেঁচে আছেন তাকে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এই কাজ দুটোই খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। থানা, পুলিশ, সিআইডি ও স্বরাষ্ট্র আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দৌড়ঝাঁপ করেও সহসাই কিছু হচ্ছে না।’

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাফর, রহমত ও হুমায়ুনের মতো এরই মধ্যে অন্তত ৩৫ বাংলাদেশি দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের সবার পরিবারেরই একই প্রশ্নÑ কীভাবে আটকাপড়াদের ফেরত আনা যায়? অবশ্য ভুক্তভোগী বেশিরভাগ পরিবারের সদস্য জানেন না, আটকেপড়া তাদের স্বজনরা কী অবস্থায় আছেন। যাদের মাধ্যমে পাচারের ঘটনা ঘটেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি তুলেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘আটকেপড়াদের ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন নয়। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি রাশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করে এবং সহযোগিতা চায়, তাহলে এটা খুব সহজেই সম্ভব।’

 

ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে মানব পাচার চক্র :

Manual8 Ad Code

ঢাকঢোল পিটিয়েও মানব পাচার প্রতিরোধ করতে পারছে না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো মানব পাচারকারী গ্রেপ্তার হলেও রাঘববোয়ালরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আলোচিত কোনো ঘটনা ঘটলে তালিকার পর তালিকা হয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা করেন দফায় দফায় বৈঠক। তালিকায় নাম আসাদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। এর মধ্যে ৬৭টি সিন্ডিকেটই বেশি ক্ষমতাধর। তারা ইউরোপসহ নানা দেশে মানব পাচার করছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ নিচ্ছে এ সিন্ডিকেটগুলো। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে ছয়জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি হয়েছে। তাছাড়া ১৭টি ট্রাভেল এজেন্সির এমন অপরাধে সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ক্ষেত্রে দেশের মানুষ ও রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে ব্র্যাকের শরিফুল হাসান বলেন, ‘ভালো কাজ ও পয়সার খবর পেলেই আমাদের দেশের মানুষ বিদেশে চলে যেতে যায় সবকিছুর বিনিময়ে। তাদের যদি এ ব্যাপারে কেউ সচেতন করতে চায় সেটাও শোনে না ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগপর্যন্ত। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া দেশে এজেন্সির মতো যেসব মানব পাচার চক্র গড়ে উঠেছে, তাদের ব্যাপারেও কঠোর হতে হবে রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে। এরা অনেক ক্ষমতাশালী হয়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।’

ট্রাভেল এজেন্টদের মাধ্যমে বেশি মানব পাচার :

Manual8 Ad Code

সংশ্লিষ্টরা জানায়, বৈধ ব্যবসার আড়ালে অবৈধভাবে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানব পাচারে জড়িত তালিকাভুক্তরা। মানব পাচার প্রতিরোধ ও তালিকাভুক্তদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের সবকটি ইউনিটকে নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তরপরও থেমে নেই মানব পাচার, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাকরির নামে পাচার করা হচ্ছে। ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে মানব পাচার করা হচ্ছে বেশি। রাশিয়া, লিবিয়া, ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে চাকরির কথা বলেই লোকজনকে নেওয়া হচ্ছে বেশি। গত এক বছরে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালিসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে দুই হাজারের বেশি মারা গেছেন। তার মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ওইসব পাচারের সঙ্গে কিছু কথিত রাজনীতিবিদ এবং বেবিচক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, বিভিন্ন এয়ারলাইনস, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও ট্রাভেল এজেন্সির কিছু অসাধু কর্মীর সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধকে পুঁজি করে সৌদি আরব হয়ে রাশিয়ায় পাঠাচ্ছে। এ ধরনের একাধিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি। এরই মধ্যে ১০ জনের বিষয়ে তথ্য বের হলে নড়েচড়ে বসে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তাদের মধ্যে কয়েকজনের হদিস মিলছে না। তদন্তে করতে গিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ৫৭ জনকে ইউক্রেন ও রাশিয়ায় পাচার করেছে। তাদের সৌদি আরব হয়ে দেশ দুটিতে পাচার করেছে। এর সঙ্গে জড়িত ১৭ ট্রাভেল এজেন্সি। তার মধ্যে একটি ড্রিম হোম ট্রাভেলস। এজেন্সিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানব পাচার করছে।

 

চটকদার বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে :

গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রাশিয়ায় ক্যান্টনমেন্টে মালি ও বাবুর্চির কাজের সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। বেতন শুরু দেড় হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা ১ লাখ ৮০ হাজার। এক মাসের মধ্যেই ভিসা শেষ করে রাশিয়ায় পাঠানো হবে। এসব বিজ্ঞাপন দেখে সহজ-সরল লোকজন বিদেশে পাড়ি দিতে উঠেপড়ে লেগে যায়। ড্রিম হোম ট্রাভেলসের হয়ে অন্তত ১০০ জনের মতো দালাল সক্রিয় আছে।

 

Manual5 Ad Code

পাচারের শিকার বেশিরভাগই যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি হয় :

পুলিশ সূত্র জানায়, মানব পাচারে ৬৭টি সিন্ডিকেট জড়িত। তাদের ধরতে বড় ধরনের অভিযান চালাবে পুলিশ। এমব সিন্ডিকেটের সদস্যরা ইউরোপেও মানব পাচার করে আসছে। পুলিশের একটি সেমিনারে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জাতীয় দাসত্ব ও মানব পাচার প্রতিরোধে জানুয়ারি মাসকে (ন্যাশনাল স্লেভারি অ্যান্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রিভেনশন মান্থ) হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় আড়াই কোটি নারী, পুরুষ ও শিশু পাচারের শিকার হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে তাদের যৌনকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, বলপূর্বক শ্রম ও ঋণ-দাসত্ব হিসেবে কেনাবেচা করা হচ্ছে। পাচারকারীরা বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষকে তাদের শিকারে পরিণত করার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। খুলনা, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রংপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা থেকেই মানব পাচার হচ্ছে।

 

ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় ছয়জন :

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে ছয়জনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছে ইন্টারপোল। পাচারকারীরা মুক্তিপণও আদায় করছে। মুক্তিপণ না পেয়ে ২০২০ সালের ২৭ মে লিবিয়া পাড়ি জমানো ৩৭ জন বাংলাদেশির মধ্যে ২৬ জনকে সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের মিজদায় গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে অনেকের বাঁচার আকুতির ভয়েস রেকর্ড শোনানো হয়েছিল তাদের স্বজনদের। এমনকি যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে পেরেছিল তাদেরও নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনা বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচার হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নানা কৌশলে মানব পাচারকারীরা সক্রিয়। অনেককে ভারত হয়ে ইতালির উদ্দেশে লিবিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। যারা এসব অপকর্মে জড়িত তাদের তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকায় ৬৭ টি সিন্ডিকেটের সদস্যদের নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। যারা দেশে আছে তাদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিন্ডিকেটের সদস্যরা দেশের বাইরেও সক্রিয়। তারা ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নামে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণও দাবি করছে বলে আমরা প্রচুর তথ্য পাচ্ছি। পাচারের দেশের তালিকায় নতুন করে যোগ হয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়া।’

 

১৭ ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকান্ড নজরদারিতে :

সিআইডি সূত্র জানায়, ট্রাভেল এজেন্সিগুলোরও তালিকা করা হয়েছে। ১৭টি ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকান্ড নজরদারি করা হচ্ছে। ভারত, নেপাল, দুবাই ও মিসর ঘুরে লিবিয়া যাওয়ার পর চক্রের সদস্যদের হাতে জিম্মি করে রাখা হয় ভাগ্যের অন্বেষণে দেশছাড়া যুবকদের। এরপর আরও ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দাবি করা হয়। তা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের নির্যাতন করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় অর্থ। টাকা সংগ্রহ করে দেশে অবস্থানরত চক্রের সদস্যরা। তারা ওই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে দুবাই পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ধাপে ধাপে সেই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়। তাছাড়া দুবাই, আম্মান ও লিবিয়া হয়ে ইতালিতে নেওয়ার জন্য রয়েছে আলাদা একটি চক্র। এই চক্রের সদস্যরা ইউরোপকেন্দ্রিক মানব পাচার করে। এ চক্রের হোতা দুবাইয়ে অবস্থানরত আফ্রিন আহমেদ। সদস্যদের মধ্যে ঢাকায় অবস্থান করছে সুজন, মামুন ও কাউসার। ঢাকার ফার্মগেটের মনিপুরীপাড়ার একটি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে চলছে চক্রের কার্যক্রম। মানব পাচার চক্রগুলো দুবাই, আম্মান ও লিবিয়া হয়ে ইতালিতে অবৈধভাবে লোক পাঠায়। বিদেশে নেওয়ার পর তাদের জিম্মি করে চালানো হয় নির্যাতন। এরপর তাদের কাছ থেকে ৫-১০ লাখ করে টাকা আদায় করা হয়। এসব টাকার ভাগ দেশে ও দেশের বাইরে অবস্থানরত চক্রের সদস্যদের কাছে পৌঁছে যায়। সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল ও বরগুনা জেলায় বেশি সক্রিয়। তার মধ্যে ঢাকায় কামাল উদ্দিন, খালিদ চৌধুরী, আবদুস সাত্তার; মাদারীপুরের নূর হোসেন শেখ, নজরুল, রবি, জুলহাস শেখ, মিরাজ হাওলাদার, রাসেল মীর, রাজন ওরফে বুলেট, মোমিন, ইলিয়াছ মীর, জাকির মিয়া; গোপালগঞ্জে রব মোড়ল; কুষ্টিয়ায় মো. কামাল; ফরিদপুরে বক্স সরদার; নড়াইলে মোক্তার মোল্লা; কিশোরগঞ্জের ভৈরবে শাওন ও জাফর ইকবাল; ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রফিকুল ইসলাম (সেলিম) ও হোসাইন; কুমিল্লায় সনাতন দাশ ওরফে দাদা, শরীফ হোসেন; শরীয়তপুরে রফিকুল ইসলাম; বরগুনায় সজল ও ইদ্রিস আলী; নোয়াখালীতে রুবেল মির্জা, নাসির উদ্দিন মির্জা ও রিপন মির্জা এবং কিশোরগঞ্জে হেলাল মিয়া, খবির উদ্দিন ও শহিদ মিয়ার নেতৃত্বে ৬৭টি সিন্ডিকেট সক্রিয়। মানব পাচারে সম্পৃক্ত মিন্টু মিয়া, স্বপন, নজরুল ইসলাম মোল্লা, তানজিরুলসহ ছয়জনকে ধরতে রেড নোটিস জারি করেছে ইন্টারপোল।

 

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, শরীয়তপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানব পাচার চক্রের সদস্যদের অবৈধ কার্যক্রম থেমে নেই। লিবিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, ইতালি, স্পেনে পাঠানোর কথা বলে পাচারকারী চক্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ইউরোপে নিতে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে দালালরা লিবিয়ায় পাঠায়। পরে সেখান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় করে পাঠায় ইতালি। এতেই ঘটে ভয়ংকর সব দুর্ঘটনা। গত দুই বছরে অন্তত ৩০ জনকে রাশিয়া ও ইউক্রেন পাঠানো হয়েছে। তাদের কয়েকজনকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকজন আহত হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘পাচারকারী চক্র নির্যাতন করে এবং এর ভিডিও পাঠিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে। টাকা দিতে না পারলে অনেককে হত্যাও করে। আমরা পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করেছি। যার মধ্যে বেশিরভাগই প্রভাবশালী। পুলিশের সবকটি ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পাচারকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে। তালিকার মধ্যে সিলেটের তালতলার ট্রাস্ট ট্রাভেল এজেন্সি, জিন্দাবাজারের ইয়াহিয়া ওভারসিজ, পুরানা পল্টনের নোয়াখালী টাওয়ারের বিএমএস ট্রাভেলস, মাহবুব এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, মতিঝিলের জিএসএ অব ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস, পুরানা পল্টনের স্কাইভিউ ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসে নানা অপকর্ম হচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।

এদিকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কয়েকজন বাংলাদেশিকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। একপর্যায়ে তাদের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করা হয়। ইতিমধ্যেই মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ধরনের কাজে জড়িত রিক্রুটিং ও ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code