প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব ইউনিয়ন পরিষদকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পৌরসভায় পরিণত করা হয়েছিল, সেসব পৌরসভাকে বিলুপ্ত করা যায় কি না সে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। গত শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই কমিশন তাদের ৪৩ পৃষ্ঠার যে প্রতিবদন জমা দেয় তাতে এই সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পৌরসভার সংখ্যা ছিল ৫০টি। বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২৮টি। এর মধ্যে জেলা পর্যায়ের পৌরসভাগুলো বাদে বাকি উপজেলা ও গ্রামীণ বাজারকেন্দ্রিক পৌরসভাগুলো বিলুপ্ত করে ওই পৌর কার্যক্রমগুলো উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে বণ্টন করে প্রশাসনিক ও আর্থিক শৃঙ্খলা সংহত করা যায়। সর্বোচ্চ দুই বর্গমাইল এলাকায় যেখানে উপজেলা ও ইউনিয়ন বিদ্যমান সেখানে পৌরসভা হওয়ার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কিছু পৌরসভা গঠন করা হয়েছে। সেই পৌরসভাগুলো সেবা প্রদান এবং রাজস্ব আহরণের দিক থেকেও সম্পূর্ণ অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ জাতীয় পৌরসভা সরকারের রাজস্বের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। তাই প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বি-পৌরকরণ সমীচীন হবে।’
প্রতিবেদনে দুর্বল পৌরসভা বাতিলের পক্ষে-বিপক্ষে জরিপের তথ্য জানিয়ে আরো বলা হয়েছে, বিগত সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশ কিছু ইউনিয়ন পরিষদকে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়েছে। গঠনকালে সেগুলো আইনানুগভাবে গঠিত হয়নি। এসব পৌরসভার আর্থিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল রয়ে গেছে।
তারা নিরাপদ পানি ও পয়োব্যবস্থাপনাসহ জরুরি পৌর সেবাগুলো সঠিকভাবে প্রদান করতে পারে না। তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতাও নিয়মিত পরিশোধ করতে পারে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঘোষিত এসব দুর্বল পৌরসভাকে যাচাই-বাছাই করে বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন ৭২.৬ শতাংশ উত্তরদাতা। অন্যদিকে ১৬.৪ শতাংশ উত্তরদাতা এই উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন। ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার বিষয়ে জাতীয় জনমত জরিপ-২০২৫’ শিরোনামের এ জরিপটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।
গত জানুয়ারি মাসে দেশের ৬৪ জেলার পল্লী ও শহর এলাকায় ৪৬ হাজার ৮০টি খানায় পরিচালিত এ জরিপে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গ্রহণ করা হয়।
এ বিষয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে দেখার সুপারিশ করেছি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এ প্রস্তাব সম্পর্কে একমত হলে অন্তর্বর্তী সরকার এটা কার্যকর করতে পারে।’
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ এর আগে বলেছিলেন, আর্থিকভাবে পুরোপুরি অচল পৌরসভার সংখ্যা শতাধিক। যেসব পৌরসভা চলে না সেগুলো দেখেশুনে অ্যাসেসমেন্ট করে বিলুপ্ত করার সুপারিশের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুর্বল পৌরসভাগুলো ইউনিয়ন নাকি উপজেলার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সেগুলোও নির্ধারণ করে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হতে পারে। এ ছাড়া যেহেতু সরকার পৌরসভার নির্বাচিত পরিষদ বিলুপ্ত করেছে, কোনো নির্বাচিত মেয়র, কাউন্সিলর নেই, সে কারণে এখন বিলুপ্ত করাটাই ভালো হবে।
প্রসঙ্গত, দুর্বল পৌরসভাগুলো নিয়ে সমস্যা দীর্ঘদিনের। এসব পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা ও পেনশনের দাবিতে রাজধানীতে এসে রাস্তায় শুয়ে আন্দোলন কর্মসূচিও পালন করেছেন। জানা যায়, দেশের প্রায় ২০০ পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পান না।
নিয়ম অনুযায়ী, পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার একটা অংশ সরকার দেবে, বাকি অংশ পরিশোধ করতে হবে পৌরসভার নিজের আয় থেকে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজস্ব আয় পর্যাপ্ত না থাকায় সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেওয়ার সামর্থ্য বেশির ভাগ পৌরসভার নেই।
জনপ্রতিনিধিদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ :
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করতে চায়। কমিশন এ বিষয়েও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে পরিচালিত জরিপে জনমত গ্রহণ করে। প্রতিবেদনে জারিপের ফল হিসেবে বলা হয়, প্রায় সব উত্তরদাতা (৯৭.১ শতাংশ) স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন। তাঁদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হওয়া উচিত এইচএসসি বা সমমান। আর ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন প্রার্থীদের শিক্ষা এসএসসি বা সমমান হওয়া উচিত। প্রার্থীদের স্নাতক বা সমমান শিক্ষাগত যোগ্যতা চান ২৫.৪ শতাংশ উত্তরদাতা।
উল্লেখ্য, সংস্কার কমিশন মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে সরাসরি ভোট চায় না। মেয়র বা চেয়ারম্যান হতে হলে আগে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের সদস্য বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ হতে পারে সদস্য বা কাউন্সিলর পদের জন্য।
একক তফসিলে সব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন :
সংস্কার কমিশন একক তফসিলে একই সঙ্গে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন চায়। এ ক্ষেত্রে কমিশনের প্রস্তাব, এটি করার জন্য আগে জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ—এই দুটি পরিষদকে ওয়ার্ড ব্যবস্থার অধীনে আনতে হবে। প্রতিটি উপজেলার অধীন ইউনিয়নগুলোর প্রতিটিকে তিনটি উপজেলা ওয়ার্ডে বিভক্ত করা যায়। এভাবে একটি উপজেলায় সর্বোচ্চ ৪৫ এবং সর্বনিম্ন ৩০টি ওয়ার্ড হতে পারে। একই রকমভাবে একটি জেলার প্রতিটি উপজেলাকে তিন ওয়ার্ডে ভাগ করা যায়। প্রতি তিন ওয়ার্ডের একটি ওয়ার্ড নারীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং আবর্তক পদ্ধতিতে তাঁর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইউনিয়ন ও পৌরসভায় বর্তমান ওয়ার্ড সংখ্যাকে জনসংখ্যা ও ভোটারসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা দরকার। ইউনিয়ন পরিষদে প্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ ভোটার বা এক হাজার জনসংখ্যা পিছু একটি ওয়ার্ড করা যেতে পারে। তবে কোনো ইউনিয়নকে জনসংখ্যার কারণে দ্বিখণ্ডিত করার প্রয়োজন নেই। জনসংখ্যা বেশি হলে ওয়ার্ড বাড়বে। একইভাবে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডও ভোটারসংখ্যা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
নির্বাচন যখন একটি একক তফসিলে হবে, তখন প্রতিটি ইউনিয়নের ভোটার ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে তিনটি ব্যালট পাবেন। একটি ব্যালট জেলা পরিষদ সদস্যের, একটি ব্যালট উপজেলা পরিষদ সদস্যের এবং একটি ব্যালট ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের। একজন ভোটার তিনটি পরিষদের তিনটি ওয়ার্ডের ভোটার হবেন। একসঙ্গে এক দিনে তিনটি পরিষদের নির্বাচন শেষ হবে। পৌরসভার একজন ভোটার একই প্রক্রিয়ায় তিনটি ভোট দেবেন। সিটি করপোরেশনের ভোটাররা দেবেন দুটি ভোট। একটি ভোট সিটি করপোরেশনের তাঁর নিজের ওয়ার্ড সদস্যকে এবং অপর ভোটটি দেবেন জেলা পরিষদের ওয়ার্ড সদস্যকে। এভাবে নির্বাচনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভোট হবে নিজ নিজ কাউন্সিল বা পরিষদের অভ্যন্তরে। সাধারণ নির্বাচনের সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে প্রতিটি পরিষদ বা কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন হবে। সেই অধিবেশনে নির্বাচিত ওয়ার্ড সদস্যরা মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচন করবেন।
একক তফসিলে একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুপারিশ সম্পর্কে অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটি আমাদের সুপারিশ। তবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে অভিন্ন কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। এর জন্য রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের একমত হওয়া দরকার। তা ছাড়া ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন হওয়া দরকার।
তিনি আরো বলেন, ‘জুনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্ভব’ বলে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সূত্রে যে সংবাদ প্রচার হয়েছে তা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। আমাদের প্রতিবেদনে আমরা বলেছি, ‘আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের জন্য দুটি একীভূত স্থানীয় সরকার আইন প্রণয়ন করে আগামী জুনের মধ্যে সব সমতল ও পাহাড়ের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।
প্রস্তাবিত ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ এ বিষয়ে বিস্তারিত কাজ এপ্রিলের আগে সমাপ্ত করতে পারে। তবে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেই তা সম্ভব হবে।’ এর অর্থ হচ্ছে, অনেক কাজ, সিদ্ধান্ত এখনো বাকি। সে ক্ষেত্রে আগামী জুনেই স্থানীয় নির্বাচন সম্ভব তা এখনো বলা যায় না।
Sharing is caring!