প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে বিয়ানীবাজারের পরিবেশ বৈচিত্র্য

editor
প্রকাশিত মার্চ ২৬, ২০২৫, ০৯:৫২ পূর্বাহ্ণ
যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে বিয়ানীবাজারের পরিবেশ বৈচিত্র্য

Manual7 Ad Code

 

স্টাফ রিপোর্টার:

বিয়ানীবাজার উপজেলা ভৌগলিক, ঐতিহাসিক ও ভূতাত্তি¡ক দিক দিয়ে এক ব্যতিক্রমী জনপদ। জেলা শহরের অনতিদূরে অবস্থিত জনপদটির এখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের মূল্যবান সব প্রতœনিদর্শন। একসময় হিংস্র জন্তুদের ভয়ে লোকজন কেনাকাটা সেরে দিনের আলোয় যার যার আস্থানায় ফিরে যেতো। বিহানবেলা এই হাট বসতো বলে এই স্থানের নামকরণ করা হয় বিহানীবাজার অর্থ্যাৎ বিয়ানীবাজার। সেই জনপদ এখন বিরাণভূমি।

 

২৫১.২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় রয়েছে ৩টি নদী এবং ১টি হাওর। একসময় এই জনপদে ছিল গহিন জঙ্গল, টিলা বেষ্টিত ভূমি। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র তথ্যমতে, বিয়ানীবাজারে ২৭০টি ছোট-বড় টিলা ছিল। ৪২৫০টি পুকুর-দিঘী থেকে ৫ হাজার মেট্রিক টনের অধিক মৎস্য আহরণ হতো। কিন্তু এই উপজেলার সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন নেই। নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে, খাল-বিল অস্থিত্ব সংকটে। রাজস্ব আহরনের জন্য সরকার বালু উত্তোলনের সুযোগ দেয়ায় নদীর সর্বনাশ হয়েছে। পাহাড়ী ঢলের ভয়াবহতায় জনপদ ও কৃষিজমি ধ্বংস হচ্ছে। অনেকগুলো খালে গ্রামীণ পানির প্রবাহপথ ‘গোপাট’ প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। খনন না করার কারণে অনেক নদী নাব্যতা হারিয়ে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে এবং নদী দখলদারদের দৌরাত্ব দিন দিন বাড়ছে। নদী দূষণের মাত্রাও বর্তমানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

Manual2 Ad Code

 

Manual6 Ad Code

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাবীব আহমদ দত্ত চৌধুরী জানান, প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করে সর্বনাশ শুরু হয়েছে ২ দশক আগে থেকে। বনের যে আয়তন কাগজে-পত্রে দেখানো হয়, সত্যিকার অর্থে বিয়ানীবাজার উপজেলায় তার এক-তৃতীয়াংশও আর অবশিষ্ট নেই। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেছে বন্যপ্রাণী। বানর আর শিয়াল মানব ঘনবসতি এলাকায় বসবাস করছে। ব্যক্তি মালিকানায় থাকা গাছও বেশি মুনাফার জন্য বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এখন বিয়ানীবাজারে ‘অরণ্যে রোদন’ করার মতো কোনো বন আর অবশিষ্ট নেই।

Manual4 Ad Code

 

Manual8 Ad Code

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ অঞ্চলের পাহাড়-টিলার ওপর সবচেয়ে বড় দুর্যোগ নেমে আসে ৯০’র দশক থেকে। আবাসস্থল নির্মাণে উজাড় করা শুরু হয় টিলা, ফসলি জমি। উপজেলায় মোট জমির পরিমাণ ৬২১২০ একর, আবাদযোগ্য জমি ৩৪৮৩৯ একর, অনাবাদী জমির পরিমাণ ৩৩০০ একর, নীট ফসলাধীন জমি ৩৪৮৩৯ একর আর খাস জমি ছিল ৪৬২০.১৪ একর। বর্তমানে সব হিসাব পাল্টে বেড়েছে অকৃষি আর অনাবাদি জমির পরিমাণ। জমিতে অপরিমিত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে আমাদের পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লোকমান হেকিম বলেন, আমরা অনাবাদি জমির পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
সম্প্রতি ‘মাটি কারবারী’ নামে একটি ব্যবসায়ী শ্রেনীরও উদ্ভব ঘটেছে। ‘মাটি কারবারী’রা প্রকাশ্য দিবালোকে পাহাড়-টিলা সাবাড় করছে। মাঝে মাঝে চাপে পড়ে প্রশাসন ২-৪টি অভিযান পরিচালনা করলেও টিলা-পাহাড় কাটা থেমে নেই।

মুড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল খায়ের অভিযোগ করেন, প্রশাসনের সঙ্গে আতাঁত করে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে মাটি কারবারীরা।

খলিল চৌধুরী আদর্শ বিদ্যা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মালিক বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সীমাহীন শব্দদূষণ প্রাকৃতিক স্বপ্নপুরী বিয়ানীবাজারকে জনস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য, আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের দিক দিয়ে ক্রমশ অনিরাপদ করে তুলছে।

বিয়ানীবাজারের টিলা বেষ্টিত দু’টি এলাকা ছিল জলঢুপ আর পাতন। গ্রাম দু’টি ছিল পাহাড়-টিলা আর অরণ্যবেষ্টিত সৌন্দর্যশোভা সাজানো। কিন্তু বর্তমানে হাতেগোনা দু’য়েকটি ছাড়া পাহাড়-টিলা অবশিষ্ট নেই। বরং টিলার স্থানে অনেক জায়গায় পুকুর ও বাড়ি তৈরি করা হয়েছে, যা নতুন কারো কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।

বিয়ানীবাজার উপজেলাজুড়ে পরিবেশ ধ্বংসের এ তান্ডবলীলা চলছে অন্তত: ৩০ বছরের বেশী সময় থেকে। অতীতে হয়েছে ধীরগতিতে, অনেক সময় নিয়ে। আর গত ২ দশকে এই তান্ডবলীলা রকেট গতি পেয়েছে। দশকের পর দশক ধরে মানুষের অসচেতনতা, লোভ আর প্রশাসনের অবহেলায় জনপদটির এই দশা। নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর প্রকৃতির আশির্বাদে বিয়ানীবাজার ছিল আকর্ষণীয়। কিন্তু যে উপজেলাটি পরিবেশ সংরক্ষণে মডেল হওয়ার কথা, সেটিকে এখন উল্টো অপবাদ নিতে হচ্ছে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code