প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ভয়ঙ্কর নভেম্বর পার করছে কানাইঘাটবাসী, ২২ দিনে ৫ খুন

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ০৬:২২ পূর্বাহ্ণ
ভয়ঙ্কর নভেম্বর পার করছে কানাইঘাটবাসী, ২২ দিনে ৫ খুন

Manual8 Ad Code

কানাইঘাট সংবাদদাতা:
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় ইদানিং খুন, অপহরণসহ ফৌজদারি অপরাধ বেড়ে গেছে। ঘটছে একের পর এক খুন। পান থেকে চুন খসলেই খুনের ঘটনা ঘটছে। চলতি নভেম্বর মাসের ২২ দিনে পাঁচ খুন ও কয়েকটি রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে আত্মহত্যার ঘটনা। এর মধ্যে বহুল আলোচিত মুনতাহা অপহরণ ও খুনের ঘটনায় কাঁদিয়েছে পুরো দেশের মানুষকে।

৩ নভেম্বর মুনতাহা অপহৃত হয়, এক সপ্তাহ পর উদ্ধার হয় তার লাশ। ৭ নভেম্বর রেজওয়ান আহমদ নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয় পুকুর থেকে। ৮ নভেম্বর ফয়জুল হোসেন নামে মসজিদের এক মুতাওয়াল্লীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়, ১৩ নভেম্বর শ্বশুড়বাড়ি থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় জুবায়ের আহমদের লাশ, ১৫ নভেম্বর কাঠমিস্ত্রী যুবক আব্দুস শুক্কুরের লাশ উদ্ধার করা হয় ফার্নিচারের দোকান থেকে, ১৮ নভেম্বর প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন হন ছাত্রদল নেতা আব্দুল মোমিন এবং ২২ নভেম্বর দোকান থেকে উদ্ধার করা হয় আব্দুর রহমান লাল মিয়া নামে এক আইসক্রিম বিক্রেতার লাশ।

শান্তিপ্রিয় জনপদ হিসেবে পরিচিত এই উপজেলায় প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন, অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং অপহরণের এসব ঘটনায় জনমনে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

চলতি নভেম্বরে সংঘটিত খুন ও আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মুনতাহা হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের অনেক গ্রেফতার হয়েছে। হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কয়েকজন ইতোমধ্যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

শিশু মুনতাহা হত্যাকান্ড:
ছয় বছরের শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের করুণ পরিণতি সর্বত্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। তার অপরহরণ ও লাশ উদ্ধারের ঘটনা পুরো দেশজুড়ে আলোচিত হয়। মুনতাহার দরদমাখা কন্ঠ আর মায়াবী চেহারার হাসিতে কেঁদেছে পুরো নেট দুনিয়া। গত ৩ নভেম্বর বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে মুনতাহা। সেদিন রাতে শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

পরিবার থেকে পুলিশ, সবাই খোঁজাখোঁজি করছিলেন শিশু মুনতাহার। জীবিত ও নিরাপদ অবস্থায় যেন মুনতাহা ফিরে আসে- এমন আকুতি ছিলো নেটিজন-সহ সকলের। সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে নিখোঁজের আট দিন পর ১০ নভেম্বর মুনতাহার লাশ বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত কর্দমাক্ত ডোবায় পুঁতে রাখা অবস্থা থেকে সরানোর সময় প্রতিবেশী নারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলে জনতা। উদ্ধার হয় মুনতাহার লাশ।

জানা যায়, নিখোঁজ নয়, পরিকল্পিত অপহরণের শিকার হয়েছিলো অবুঝ শিশুটি। মুনতাহা হত্যা ও অপহরণের ঘটনায় প্রধান আসামী মার্জিয়াসহ চার জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মার্জিয়া ছিলো মুনতাহার প্রতিবেশি ও গৃহশিক্ষক।

অভিযোগ রয়েছে, পড়ানো থেকে মার্জিয়াকে বাদ দেওয়ায় এবং কিছুদিন আগে তাকে চুরির অপবাদ দেওয়ায় ক্ষোভ থেকে মুনতাহাকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়।

পুকুর থেকে যুবক রেজোওয়ানের লাশ উদ্ধার:
মুনতাহাকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না এবং নেট দুনিয়ায় তার বিষয়টি ভাইরাল, ঠিক তখন ৭ নভেম্বর তারিখে ৩০ বছরের যুবক রেজোওয়ান আহমদের লাশ উদ্ধার করা হয় নিজ বাড়ির পুকুর থেকে। পেশায় অটোরিক্সা চালক নিহত রেজোয়ান উপজেলার ২নং লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের গোরকপুর (খাইল্লাকোনা) গ্রামে খলিলুর রহমানের ছেলে।

পরিবারের দাবি, রেজোওয়ান হত্যাকান্ডের শিকার। তাকে পুকুরে ফেলে হত্যা করা হয়েছে অথবা হত্যার পর পুকুরে তার লাশ ফেলে রাখা হয়েছে।

চাচাতো ভাইকে গলাকেটে হত্যা:
জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে আপন চাচাতো ভাইকে গলাকেটে হত্যা করেছে এক পাষন্ড। ৮ নভেম্বর উপজেলার দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের বাউরভাগ নয়াগাউ গ্রামে ৬৫ বছর বয়সী ফয়জুল হোসেনকে গলাকেটে হত্যা করে তারই আপন চাচাতো ভাই সুলতান আহমদ (৪৮)। নিহত ব্যক্তি নিজ মহল্লার মসজিদের মুতাওয়াল্লী ছিলেন। ঘটনার পর গ্রামবাসী সাথে সাথে সুলতানকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ ও জনতার উপস্থিতিতে সুলতান নিজেই স্বীকার করে যে, সে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। যে ধারালো দা দিয়ে সে জবাই করে জনতার উপস্থিতিতে পুলিশ সেটা উদ্ধার করে।

শ্বশুর বাড়ির গাছে ঝুলছিল জামাইয়ের লাশ:
১৩ নভেম্বর বড়চতুল ইউনিয়নের চতুল সরুফৌদ গ্রামের শ্বশুর বাড়ির গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় জুবায়ের আহমদ (৫০) নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জুবায়ের আহমদ পার্শ্ববর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামের আব্দুল বারীর ছেলে। এলাকাবাসীর ধারণা দাম্পত্য কলহের জেরে জুবায়ের আত্মহত্যা করতে পারেন।

কাঠমিস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু:
১৫ নভেম্বর উপজেলার দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের নয়াগাউ মাছুখাল বাজারে একটি ফার্নিচারের দোকান থেকে আব্দুশ শুক্কুর (২৬) নামের এক কাঠমিস্ত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। এটা খুন না কি আত্নহত্যা এ নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।অনেকেই এটাকে আত্মহত্যার ঘটনা বলতে নারাজ।

Manual8 Ad Code

তাদের মতে, হত্যা করে যুবকের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দোকানে। নিহত আব্দুশ শুক্কুর একই ইউনিয়নের কায়স্তগ্রামের আব্দুন নূরের ছেলে।

প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রদল নেতা খুন:
১৮ নভেম্বর বিকেলে কানাইঘাট বাজারের ভেতর প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন ছাত্রদল নেতা আব্দুল মুমিন (২৮)। তিনি কানাইঘাট পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক ও পৌরসভার ধনপুর গ্রামের তাজ উদ্দিনের ছেলে।

জানা যায়, পূর্ব বিরোধের জের ধরে ঘাতক রাজু ক্ষুর দিয়ে মুমিনের তলপেটে আঘাত করে। এই সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা এগিয়ে এলে রাজু পালিয়ে যায়। পরে মুমিনকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। প্রকাশ্যে দিবালোকে জনসমাগমস্থলে ছাত্রদল নেতার হত্যার ঘটনাটি জনমনে ভীতি আরো বাড়িয়ে দেয়। অজানা আতংক ছড়িয়ে পড়ে জনমনে।

দোকান থেকে আইসক্রিম বিক্রেতার লাশ উদ্ধার: সর্বশেষ ২২ নভেম্বর কানাইঘাটে আব্দুর রহমান লাল মিয়া (৪০) নামে এক আইসক্রিম বিক্রেতার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত লাল মিয়া উপজেলার বড়চতুল ইউনিয়নের লখাইরগ্রামের মৃত হাসন আলীর পুত্র।

জানা যায়,লাল মিয়া দীর্ঘদিন থেকে কানাইঘাট পৌর শহরে একটি দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে ফেরি করে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। কয়েকদিন থেকে লাল মিয়ার মুঠোফোন বন্ধ থাকায় পরিবারের লোকজন তার সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। এতে সন্দেহ হয় পরিবারের। ২২ নভেম্বর শুক্রবার সকালে তার পরিবারের লোকজন এসে ভাড়াটিয়া দোকান ঘরের বাইরে তালা দেয়া দেখতে পান। পরে তালা ভেঙে ঘরের চৌকি খাটের উপর মাথায় গুরুতর জখমপ্রাপ্ত লাল মিয়ার রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখেন তারা। তবে কি কারনে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে তার কারন জানা যায়নি।

গত দুই মাসে কানাইঘাট উপজেলায় আরো কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এত কম সময়ের ব্যবধানে এত সংখ্যক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে ভয় ও আতংক বিরাজ করছে।

ইদানিং কেন খুন ও নানা রকম ফৌজধারি অপরাধের ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলো কানাইঘাট উপজেলায়? এই ব্যাপারে কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি গবেষক এহসানুল হক জসীম তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার অভাবে কানাইঘাট উপজেলায় খুন, গুম ও রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।

এহসানুল হক জসীম বলেন, ‘দোষীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। সকল ফৌজধারী অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মানুষের মাঝে নৈতিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে আলেম সমাজকেও ভূমিকা রাখতে হবে। ধর্মীয় বয়ানে নৈতিকার শিক্ষার উপর জ্বোর দিতে হবে।

Manual1 Ad Code

কানাইঘাটের স্থানীয় প্রশাসনকে এই নিয়ে ভাবতে হবে। বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিতে থানা পুলিশকে আদালতের আগের কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে।’

এই প্রতিবেদক কথা বলেন কানাইঘাট উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মো. মহি উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, ‘নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে ইদানীং এসব ঘটনা ঘটছে। মানুষের মাঝে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে প্রতিটি পরিবারের
অভিভাবককে সন্তানের বিষয়ে আরো অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।’

Manual5 Ad Code

কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘কানাইঘাটে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে পুলিশ। এই হত্যাকান্ডগুলো অনাকাঙ্খিত। এসব হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কয়েকজনে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। আসামিদের মধ্যে কয়েকজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।’

Manual1 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code