প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

থমকে আছে আবাসন শিল্প

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ২৬, ২০২৪, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ
থমকে আছে আবাসন শিল্প

Manual8 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা ‘ড্যাপ’ নামে পরিচিত। গত বছরের আগস্ট থেকে এটি কার্যকর করা হয়। কিন্তু শুরু থেকে ড্যাপ (২০২২-৩৫) নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) নেতারা বলেছেন, নতুন ড্যাপ বৈষম্যমূলক। বর্তমানে আবাসনশিল্পে যে সংকট চলছে তাতে প্রধান সমস্যা এই ড্যাপ। এটি আবাসন খাতের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ড্যাপ সংশোধনের দাবি জানিয়ে বলেন, এটি সংশোধন না করা হলে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে দেশের কর্মসংস্থানে অবদান রাখা আবাসন খাত।

Manual2 Ad Code

 

কী আছে নতুন ড্যাপে

Manual7 Ad Code

 

খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ড্যাপের খসড়া পরিকল্পনায় ফ্লোর এরিয়া রেশিওর (এফএআর) ভিত্তিতে ভবনের আয়তন নির্ধারণের সুপারিশ করে রাজউক। এতে গুলশান, বনানী কিংবা ধানমন্ডির মতো পরিকল্পিত এলাকার তুলনায় মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, বাসাবোসহ অপরিকল্পিত এলাকায় ভবনের আয়তন কম নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে বেশির ভাগ এলাকায় আগে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য যে আয়তন বা জায়গা পাওয়া যেত, সে তুলনায় এখন ৬০ শতাংশ পাওয়া যাবে। এতে জমির মালিক, ডেভেলপার কোম্পানি ও ক্রেতা সবাই ক্ষতির মুখে পড়বেন।

নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, আবাসন খাতের জন্য ভবন নির্মাণে পরিকল্পিত এলাকা যেমন- গুলশানে পাঁচ কাঠা জায়গায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও বেশি ধরা হয়। ফলে গুলশানে উঁচু ভবন করা যাবে। ফ্ল্যাটসংখ্যা বেশি হবে। পক্ষান্তরে অপরিকল্পিত এলাকা যেমন- বাসাবোতে পাঁচ কাঠা জায়গায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও কম থাকায় বাসাবোতে সবোর্চ্চ চার থেকে পাঁচ তলার বেশি ভবন করা যাবে না। ফলে ফ্ল্যাটসংখ্যাও কম হবে। অর্থাৎ যেসব এলাকায় যত বেশি এফএআর, সেখানে ভবনের আয়তন তত বেশি পাওয়া যায়। ফলে ফ্ল্যাটসংখ্যাও বেশি হবে।

রিহ্যাব নেতারা বলেন, ড্যাপে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকার জন্য পৃথকভাবে ভবন নির্মাণের যে ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআর নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি বৈষম্যমূলক। নির্দিষ্ট কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় এমনটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

Manual1 Ad Code

নতুন ড্যাপের কারণে আবাসন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে দাবি করছেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর থেকে জমির মালিকরা ভবন করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। নতুন প্রকল্পও নেওয়ার হার কমেছে। ড্যাপ সংশোধন না হলে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাবে। এমনিতেই এই ব্যবসায় মন্দা চলছে। নতুন ড্যাপের কারণে মন্দা আরও গভীর হয়েছে।

রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী তানভীরুল হক প্রবাল বলেন, ‘ড্যাপের সমস্যা নিরসন হচ্ছে না বলে ডেভেলপাররা নতুন প্রজেক্ট নিতে পারছে না। বসুন্ধরা, ধানমন্ডিসহ পরিকল্পিত এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও বেশি ধরা হয়েছে নতুন ড্যাপে। এটি যত বেশি হবে, তত বেশি উচ্চ ভবন করা যাবে। কিন্তু মিরপুর, বাড্ডাসহ অপরিকল্পিত এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও কম। ফলে এসব এলাকায় পাঁচতলার বেশি উঁচু ভবন করা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে পরিকল্পিত এলাকা খুবই কম। ৯০ শতাংশই অপরিকল্পিত এলাকা। নতুন ড্যাপে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে জমির মালিক, ডেভেলপার কোম্পানি ও ফ্ল্যাটের ক্রেতা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’

রাজউক বলেছে, শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানোর জন্য অপরিকল্পিত এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও কমানো হয়েছে। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে রিহ্যাবের সাবেক এই নেতা বলেন, ‘এ ধারণা ঠিক নয়। আমি মনে করি, ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো যাবে না। সারা দুনিয়ায় এখন উঁচু ভবন হচ্ছে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ড্যাপ সংশোধন করলে আবাসন খাত চাঙা হবে। এটি করা হলে জমির মালিক, ডেভেলপার ও ক্রেতা সবাই উপকৃত হবেন।’

রিহ্যাব অপরিকল্পিত এলাকায় ভবনের আয়তন বাড়ানোর পাশাপাশি প্রস্তাবিত বিধিমালা সংশোধনের একগুচ্ছ প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে রাজউককে দিয়েছে। রাজউক বলেছে, তারা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করবে। রিহ্যাবের সহসভাপতি আবদুল লতিফ বলেন, ‘২০ অক্টোবর রাজউকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। রাজউক চেয়ারম্যান আমাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ড্যাপের কারণে পুরো সেক্টরই স্থবির হয়ে গেছে। নতুন নিয়মে জমির মালিকরা ভবন নির্মাণে উৎসাহিত হচ্ছেন না। আবার ডেভেলপারদেরও পোষাচ্ছে না। যার জন্য এই সেক্টরে একটা কৃত্রিম শূন্যতা তৈরি হয়েছে। দুই বছর ধরে এই শূন্যতা চলছে বলে জানান তিনি। ড্যাপ সংশোধন হলে এই সেক্টর আবার চাঙা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

Manual4 Ad Code

রাজউক ২০২০ সালে দ্বিতীয় ড্যাপের (২০২২-৩৫) খসড়া প্রকাশ করে। গত বছরের আগস্টে পাস হওয়া এই ড্যাপ ছয়টি স্বতন্ত্র অঞ্চলে বিভক্ত। সেগুলো হচ্ছে কেন্দ্রীয় অঞ্চল: ঢাকা শহর, উত্তর অঞ্চল: গাজীপুর সিটি করপোরেশন, পূর্ব অঞ্চল: কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণ অঞ্চল: নারায়ণগঞ্জ, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল: কেরানীগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিম অঞ্চল: সাভার উপজেলা।

রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘ড্যাপের সমস্যার সমাধান না হলে আবাসনশিল্প কোনো দিন ভালো হবে না। ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশই অপরিকল্পিত এলাকা। নতুন ড্যাপের ফলে ওই সব এলাকায় পাঁচতলার ওপরে ভবন করতে দিচ্ছে না রাজউক। ফলে ওই সব এলাকায় নতুন কোনো ভবন তৈরি হচ্ছে না। আমরা ড্যাপের সংশোধনী চাই। আগের নিয়মে ফিরে যেতে চাই। যেখানে ভবন নির্মাণে এলাকাভেদে কোনো পার্থক্য থাকবে না।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবনের বেশি আয়তন বা উচ্চতা দিলে ঢাকা আরও বেশি বাসযোগ্য হবে।’
রিহ্যাবের সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘এ মুহূর্তে আবাসন খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা ড্যাপ। এ সংকটের সমাধান না হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে আবাসন খাত।’

 

নির্মাণসামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া

 

ডলারসংকট, কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতাসহ নির্মাণশিল্পের অন্যতম উপকরণ রড, সিমেন্টসহ প্রায় সব ধরনের উপকরণের দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে এখনো প্রতি টন রড গ্রেডভেদে ৯০ থেকে ৯২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার বাইরে দাম আরও বেশি। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ‘বড় বড় আবাসন কোম্পানি থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায়ে অনেকে নির্মাণকাজ করলেও সরকার পরিবর্তনের ফলে উন্নয়নের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তাই রডের চাহিদা কমে গেছে। তবে চাহিদা কমলেও দাম কমেনি।’

রিহ্যাব নেতারা বলেন, ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম আগে থেকেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। বিভিন্ন কারণে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাট কেনা এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই আবাসন খাত এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। এর মধ্যে নির্মাণসামগ্রীর দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এতে ফ্ল্যাট বিক্রি তলানিতে পৌঁছেছে।

রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি বিল্ডিং ফর ফিউচার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরুল হক প্রবাল বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে ভোক্তারা এখন আগের মতো ফ্ল্যাট ক্রয়ে উৎসাহী নয়। অনেক দিন ধরে আবাসন ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। ড্যাপের কারণে মন্দা আরও বেশি হয়েছে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code