প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

সাগর থেকে ডাঙায় ধাপে ধাপে জ্বালানি তেল চুরি

editor
প্রকাশিত মে ২২, ২০২৫, ১২:০৩ অপরাহ্ণ
সাগর থেকে ডাঙায় ধাপে ধাপে জ্বালানি তেল চুরি

Manual5 Ad Code

 

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

• চুরিতে শত শত কোটি টাকা সরকারি অর্থের ক্ষতি
• অভিযান চালাতে কোস্টগার্ডকে চিঠি বিপিসির

আমদানি করা রাষ্ট্রীয় জ্বালানি তেল বঙ্গোপসাগরে মাদার ভেসেল থেকে গ্রাহক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতিটি স্তরেই চুরির অভিযোগ উঠেছে। মাদার ভেসেল থেকে ডিপো, নৌপথের লাইটার জাহাজ, সড়কপথের ট্যাংক লরি কিংবা রেলওয়ের ওয়াগন থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় এ সম্পদ। রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।

প্রতিবেদনটির তথ্য বলছে, রাষ্ট্রীয় এ জ্বালানি তেল চুরির কারণে শত শত কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে সরকার। এ কাজে জাহাজের নাবিক থেকে শুরু করে ডিপোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি এবং তেল চুরির শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত।

Manual2 Ad Code

এরই মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাটির সুপারিশের ভিত্তিতে নৌপথে অভিযান পরিচালনার অনুরোধ জানিয়ে কোস্টগার্ডকে চিঠি দিয়েছে রাষ্ট্রীয় পেট্রোলিয়াম জ্বালানি আমদানি, পরিশোধন, বিপণন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। পাশাপাশি নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত থাকার বিষয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে বিপিসি।

 

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে দেশে ৬৭ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন পেট্রোলিয়াম জ্বালানি সরবরাহ করে বিপিসি। এর মধ্যে ৬১ দশমিক ৮৮ শতাংশ পরিবহন, ১৫ শতাংশ কৃষি, ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ শিল্প, ১৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ বিদ্যুৎ, শূন্য দশমিক ৯১ শতাংশ গৃহস্থালি এবং ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ অন্য খাতে ব্যবহার হয়েছে।

ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ৬২ দশমিক ৯৩ শতাংশ ডিজেল, ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ ফার্নেস অয়েল, ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ পেট্রোল, ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ অকটেন, ১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কেরোসিন, ৮ শতাংশ জেট এ-১ এবং ১ দশমিক ৮০ শতাংশ অন্য পেট্রোলিয়াম পণ্য রয়েছে। চলতি (২০২৪-২০২৫) অর্থবছরে প্রাক্কলিত চাহিদা ৭৪ হাজার টন।

বর্তমানে প্রধান স্থাপনাসহ সারাদেশে নৌভিত্তিক ডিপো ১১টি, রেলহেড ডিপো নয়টি, বার্জ ডিপো দুটি, একটি গ্যাস ফিল্ড সংলগ্ন ডিপো, চারটি অ্যাভিয়েশন ডিপোসহ মোট ২৭টি স্থানে ডিপো রয়েছে বিপিসির। বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) মাধ্যমে সারাদেশে বিপণন করা হয়।

 

মোট জ্বালানির ৩৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ঢাকা, ২৬ দশমিক ৪২ শতাংশ চট্টগ্রাম, ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ সিলেট, ১০ দশমিক ৯৪ শতাংশ রাজশাহী, ৬ দশমিক ২২ শতাংশ রংপুর, ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ খুলনা, ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ বরিশাল এবং ২ দশমিক ৯২ শতাংশ ময়মনসিংহ বিভাগে ব্যবহার হয়। মোট সরবরাহ করা জ্বালানির ৬৭ দশমিক ১১ শতাংশ নৌপথে, ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ রেলপথে এবং ২৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ সড়কপথে পরিবহন হয়।

 

তেল ডিপোতে নেওয়ার সময় অনিয়ম

জ্বালানি তেল চুরি নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজযোগে আমদানি করা তেল গ্রহণ, অয়েল ট্যাংকারযোগে ডিপোতে পৌঁছানো বা তেল সরবরাহ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে তেল চুরির ঘটনা ঘটে।

জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রথম ধাপেই তেল চুরি শুরু হয়। মাদার ভেসেল থেকে তেল নিয়ে লাইটারেজ জাহাজ গুপ্তাখালে প্রধান ডিপোর জেটিতে আসে। সেখান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তিনটি বিপণন কোম্পানির অয়েল ট্যাংকে তেল সরবরাহ করা হয়। জাহাজ থেকে ডিপোতে তেল বুঝিয়ে দেওয়ার সময় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সঙ্গে সমঝোতা করে পরিমাপে কম/বেশি দেওয়া হয়।

 

Manual6 Ad Code

এছাড়াৎ জ্বালানি তেল বেশি তাপমাত্রায় বেশ তরল থাকে ও ঘনত্ব কমে যায়, এতে পরিমাপে তেল বেড়ে যায়। আবার তাপমাত্রা কমে গেলে পরিমাপে কমে যায়। তাপমাত্রাজনিত ক্ষতি ও পরিবহনজনিত ক্ষতি সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু তাপমাত্রাজনিত বৃদ্ধির কোনো লাভ কখনো উল্লেখ করা হয় না।

 

ডিপো থেকে তেল বিক্রির সময় অনিয়ম

বিপণন কোম্পানির চট্টগ্রাম প্রধান ডিপো থেকে চারটি পন্থায় তেল সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী তেল পরিবহনকারী লাইটারেজ জাহাজ প্রধান ডিপো থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তেল নিয়ে যায়। প্রায় প্রতিটি জাহাজেই গোপন জায়গা রয়েছে, যেখানে ৮শ থেকে এক হাজার লিটার তেল রেখে দেওয়া যায়। কোনো জাহাজে ৫০ হাজার লিটার তেল পরিবহনের ভাউচার থাকলেও ডিপো কর্তৃপক্ষ উক্ত জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ৮শ থেকে এক হাজার লিটার তেল বেশি দিতে পারে।

রেলওয়ের তেলবাহী ওয়াগনে তেল ভরার সময় জাহাজের মতো একইভাবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তেল বাড়িয়ে দিতে পারে। ট্যাংক লরিতে তেল ভর্তির সময় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিটি ট্যাংক লরিতে ভাউচারের বাইরে ১৫০-২শ লিটার বাড়তি তেল দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। একইভাবে ড্রামে তেল ভর্তির সময় ২শ লিটারের ড্রামে ১৫-২০ লিটার বাড়তি দেওয়া হয় বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

 

কর্ণফুলী নদীতে তেল চুরির প্রক্রিয়া

গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, কর্ণফুলী নদীতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাহাজ মালামাল নিয়ে আসে। জোয়ার-ভাটার হিসাবে একটা নির্দিষ্ট সময় জাহাজগুলো নোঙর অবস্থায় থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় তেল চুরির ঘটনা। জাহাজগুলো প্রয়োজনের তুলনায় বেশি তেল বহন করে। জাহাজে থাকা নাবিক ও অন্য স্টাফদের জন্য খাবারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জাহাজে পৌঁছে দেওয়ার নামে বহির্নোঙরে ভাসমান জাহাজ থেকে ড্রামে ভরে তেল নামানো হয়। পরবর্তীসময়ে মাঝিরা নৌকায় তুলে রাতের অন্ধকারে সিন্ডিকেটের কাছে এসব তেল পৌঁছে যায়।

Manual8 Ad Code

পরে সুবিধাজনক সময়ে ভাউচার করে খোলাবাজার, স্থানীয় পেট্রোল পাম্প, ইঞ্জিনচালিত বোট, লাইটার জাহাজে বাংকারিং/বিক্রি করা হয়। রাষ্ট্রীয় তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা অয়েল লিমিটেডের তেল জাহাজে করে সারাদেশে পরিবহনের সময় নাবিক ও জাহাজের অন্য স্টাফদের সহযোগিতায় তেল চুরির ঘটনা ঘটে বলে প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়।

 

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ৭ সুপারিশ

>>পদ্মা, মেঘনা, যমুনা অয়েল কোম্পানিকে দ্রুত অটোমেশনের আওতায় আনা এবং তেলের ডিপোতে কর্মরত অসৎ ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

 

>>জ্বালানি তেল চুরি ও ভেজালরোধে তেল পরিবহনে জড়িত সব ট্যাংক লরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং ডিজিটাল লক বসানোর ব্যবস্থা করা।

>>জ্বালানি তেলের চুরি রোধে স্থানীয় প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা।

>>তেল লোড-আনলোডের সব স্থান সিসিটিভির আওতায় আনার ব্যবস্থা করা।

 

>>তেল পরিমাপে নিয়োজিত সার্ভেয়ার কোম্পানির প্রতিনিধি, তেলবাহী জাহাজের মাস্টার, নাবিকসহ কর্মরতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং বিপিসির স্বতন্ত্র ইন্সপেকশন কমিটি গঠনের মাধ্যমে জাহাজ থেকে তেল পরিমাপ ও সরবরাহ পদ্ধতি পরিদর্শন করা।

>>বিপিসির ট্রানজিট লস বা অপারেশন লসের যৌক্তিক হার নির্ধারণ করা এবং অভ্যন্তরীণ মনিটরিং কমিটি গঠনের মাধ্যমে ডিপোগুলোতে কাগুজে রেকর্ড অনুযায়ী প্রকৃত মজুত রয়েছে কি না তা যাচাই করা।

>>নিরাপদে জ্বালানি তেল সরবরাহে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং পরিচালনা, বিপিসি মূল ডিপোগুলো অটোমেশন প্রকল্প ও চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইনে তেল সরবরাহ প্রকল্প দ্রুত কার্যকর করা প্রয়োজন।

 

বিপিসির পদক্ষেপ

জ্বালানি তেল চুরি নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার অনুরোধ জানিয়ে গত ১৭ মে কোস্টগার্ডকে চিঠি দেয় বিপিসি। বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান কোস্টগার্ড মহাপরিচালককে এ চিঠি দেন।

এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তিতে করে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কোস্টগার্ডকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন প্রক্রিয়াধীন।’

তিনি বলেন, ‘আমদানি করা ক্রুড ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) মাধ্যমে পরিশোধন করে বিপণন কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হয়। ইআরএল থেকে সরবরাহ করা জ্বালানিপণ্য পরিমাপের জন্য কাস্টডি ফ্লো মিটার নামে অটোমেশন প্রকল্প এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি চালুর জন্য ইআরএল আরও এক মাস সময় চেয়েছে। এরপর ইআরএল পুরোপুরি অটোমেশনের আওতায় চলে আসবে। পাশাপাশি এসপিএম ও ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন প্রকল্প শেষ হয়েছে। প্রকল্প দুটির কার্যক্রম শুরু হলে জ্বালানি জাহাজ থেকে গ্রহণ থেকে শুরু করে ডিপোগুলোতে পাঠানো পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপে সিস্টেম লস কিংবা চুরি অনেকাংশে কমে যাবে।’

বিপিসির এ পরিচালক বলেন, ‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনার প্রধান ডিপোসহ সবগুলো ডিপোকে অটোমেশনের আওতায় আনার জন্য একটি প্রকল্পের ফিজিবিলিটি চলছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে সারাদেশের জ্বালানি তেল বিপণন কার্যক্রম পুরোপুরি অটোমেটেড হয়ে যাবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সময়ের প্রয়োজন। তাছাড়া বিপিসির জনবলেও সংকট রয়েছে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code