প্রজন্ম ডেস্ক:
‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ এবং ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এর খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষত সংস্কার বাস্তবায়নের কাঠামো, আইনি ভিত্তি এবং ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে দলগুলোর ভিন্নমত প্রকট। এ কারণেই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ঐকমত্যের সংকট দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ পরিস্থিতি রাজনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলছে। সনদের কিছু বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে; এমন প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে ওই তিন দল বলছে, জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে তা বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে। তা না হলে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। অন্যদিকে চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ যে খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে; তাতে আপত্তি রয়েছে বিএনপির। অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে নারাজ তারা। এ ছাড়া জাতীয় সনদের সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়েও দলগুলোর মধ্যে রয়েছে মতভেদ। ঘোষণাপত্র ও সনদের কয়েকটি ক্ষেত্রে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো, জামায়াত, এনসিপিসহ ইসলামী দলগুলো এবং বাম দলগুলো আলাদা আলাদা অবস্থান নেওয়ায় ঐকমত্যে পৌঁছাতে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সবমিলিয়ে সংস্কার বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে ঐকমত্যের সংকট।
সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় বিভাজন : জুলাই সনদে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দুই বছরের মধ্যে সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এই প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি তুলেছে। তাদের মতে, সময়সীমা নির্ধারণ করলেই বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা আসে না। বরং এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে; যার মাধ্যমে নতুন সরকার বাধ্য থাকবে সনদের ধারাগুলো বাস্তবায়ন করতে।
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদ মানে, যত আলোচনা হয়েছে, সবই কেবল খাওয়া-দাওয়া আর আলাপচারিতা। যদি বলা হয়, আইনি ভিত্তির কোনো সম্ভাবনা নেই, তা হলে এ সনদের দরকারই নেই।’ তিনি সনদ বাস্তবায়নের জন্য তিনটি সম্ভাব্য পথ উল্লেখ করেন: আইনি কাঠামো প্রণয়ন, গণভোট এবং রেফারেন্ডাম।
অন্যদিকে এনসিপি অভিযোগ করেছে যে, আলোচনা ছাড়াই কমিশন সনদের খসড়া প্রকাশ করেছে, যা দলটির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘সরকার যে খসড়া দিয়েছে তা পরিণত নয়। আমরা একটি সংশোধিত খসড়া জমা দিয়েছি। আলোচনার মধ্যে আছি, তবে এখনও স্পষ্ট অগ্রগতি নেই।’
আন্দোলনের স্বীকৃতি ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব : নাগরিক অধিকার পরিষদসহ কেউ কেউ দাবি তুলেছে, সনদে গত এক যুগ ধরে চলা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যথাযথ স্বীকৃতি নেই। দলগুলোর মতে, বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ যে সংগঠনগুলো ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তাদের ভূমিকার স্পষ্ট উল্লেখ থাকা উচিত ছিল।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু খসড়ায় তার কোনো উল্লেখ নেই। বরং মনে হচ্ছে, এটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে খুশি করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, ‘জুলাই সনদের খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের স্বীকৃতি অনুপস্থিত। অথচ একাত্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করে কেবল জুলাইকে কেন্দ্র করাই খসড়ার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।’
অভ্যুত্থান স্বীকৃতিতে বিএনপির দ্বিধা : ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এর খসড়ায় ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তাতে সবচেয়ে স্পষ্ট আপত্তি এসেছে বিএনপির পক্ষ থেকে। দলটির আশঙ্কা, এমন সাংবিধানিক স্বীকৃতি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও আইনগত জটিলতা তৈরি করতে পারে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা খসড়া হাতে পেয়েছি। দলীয়ভাবে দ্রুত পর্যালোচনা করে কমিশনে মতামত জানাব। কিন্তু অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে ভবিষ্যতেও যেকোনো ধরনের বিদ্রোহের পক্ষে নজির সৃষ্টি হতে পারে।’ কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে এবং সব দলের মতামতের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঘোষণাপত্রের ভাষা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে বিতর্ক : ২৬ দফার ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এ জনগণের অভিপ্রায় ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপান্তরের আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জনগণ নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা করছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় তা উল্লেখ থাকবে এবং ঘোষণাপত্রটি সংযুক্ত তফসিল হিসেবে যুক্ত হবে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘বিগত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।’ ঘোষণাপত্রের ভাষায় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল ও সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষা প্রয়োগ করায় কেউ কেউ এটিকে পক্ষপাতদুষ্ট বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, এমন ভাষা রাজনৈতিক সমঝোতার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা ও অগ্রগতি : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত খসড়া তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবারের মধ্যে আমরা একটি আপডেটেড খসড়া সব দলের হাতে তুলে দিতে পারব বলে আশা করছি।’ তিনি আরও জানান, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ও মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সংক্রান্ত ধারাগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে সংবিধানে পরিবর্তন কীভাবে আনা হবে-সে বিষয়ে এখনও কিছু ভিন্নমত রয়েছে।
কমিশনের একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের দেওয়া সুপারিশ ও আপত্তিগুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এবং তা ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর : জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র নিয়ে যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে, তা রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বিশেষত, সংস্কার বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো, সাংবিধানিক স্বীকৃতির পরিণতি এবং ঘোষণাপত্রের ভাষা নিয়ে চলমান বিতর্কে বহুস্তরীয় বিভাজন স্পষ্ট। কমিশন আশাবাদী হলেও সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ও সদিচ্ছা ছাড়া এই সনদ কার্যকর করার পথ অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠবে।
Sharing is caring!