প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

দারিদ্র্যের তথ্য প্রকাশে গোপনীয়তা

editor
প্রকাশিত আগস্ট ২, ২০২৫, ০৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ
দারিদ্র্যের তথ্য প্রকাশে গোপনীয়তা

Manual7 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

দারিদ্র্যের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতেও এবার গোপনীয়তা আর সংখ্যার কাটছাঁটের আশ্রয় নিয়েছে সরকার। দেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে কোনো সংবাদ সম্মেলন বা সাংবাদিকদের না জানিয়ে। শুধু একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে শেষ করা হয়েছে এত বড় তথ্যের উপস্থাপন। আর সেই প্রতিবেদনে আগের ৩৬ শতাংশ দারিদ্র্যকে নামিয়ে দেখানো হয়েছে ২৪ দশমিক ০৫ শতাংশ, তাও আবার ২০১৯ সালের পুরোনো তথ্য ঘেঁটে।

জানা গেছে, সাত বছরের পুরোনো তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেখিয়েছে, দেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। অর্থাৎ, দেশের প্রতি চারজনের একজন বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। ২০২১ সালে একই প্রতিবেদনে ৩৬ শতাংশ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের তথ্য উঠে এসেছিল। কিন্তু দরিদ্রতা বেড়ে যাওয়ার খবর বেড়ে যাওয়াকে নেতিবাচক ধরে নিয়ে তখন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি সরকার। কিন্তু চার বছর পর আগের প্রতিবেদন কাটছাঁট করে দারিদ্র্য দেখানো হয়েছে ২৪ শতাংশের কিছু বেশি। আগের অপ্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হিসাব এসেছিল ৬ কোটি ৫১ লাখের বেশি। কিন্তু সেটিকে কাটছাঁট করে দেখানো হয়েছে, দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছেন। এ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার গ্রাম এলাকায় সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দেশের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছে।

Manual2 Ad Code

বৃহস্পতিবার সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) প্রকাশ করেছে। এমপিআই প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সরকারি এসব তথ্য প্রকাশেও লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। কোনো সংবাদ মাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়াই দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এ ক্ষেত্রে শুধু সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপের (২০২২) তথ্য অনুযায়ী, দেশের দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ ২০১৯ সালের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জিইডি বলছে, দেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বেড়ে ২৪ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ, ২০১৯ সালেই দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার খবর গোপনে প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। ২০১৩ সাল থেকে এই প্রকল্প নেওয়া হয়, এতদিনেও রিপোর্ট প্রকাশ পায়নি। এখন যদিও রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে তাও লুকোচুরি করে। তাও ২০১৯ সালের বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।

জানা গেছে, এ প্রতিবেদনটি প্রকাশের কথা ছিল ২০২১ সালে। ওই সময় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ৬ কোটি ৫১ লাখেরও বেশি মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মুখোমুখি।

Manual4 Ad Code

শিশুদের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের কথা উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৭ বছরের কম বয়সি শিশু রয়েছে এমন ৫৭ শতাংশ পরিবার বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মুখোমুখি এবং সামগ্রিক পরিবারের তুলনায় এই হার ২১ শতাংশ বেশি। সেখানে গ্রামীণ এলাকা বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে রয়ে গেছে, তবে সিলেট, চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগকে কেন্দ্র করে নতুন দারিদ্র্য পকেট চিহ্নিত করা হয়েছে। শহরাঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মুখোমুখি, যেখানে গ্রামাঞ্চলে এই হার ৪০ শতাংশ, যেখানে ৮৬ শতাংশেরও বেশি বহুমাত্রিক দরিদ্র মানুষ বাস করে।

ওই সময়ই বিবিএস দেখিয়েছিল, দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এই বিষয়ে আর কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। স্বাধীন গবেষকরা বলছেন যে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অতিরিক্ত ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) জরিপ করে। ওই জরিপের প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জিইডি ‘বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই)’ প্রতিবেদনের মূল তথ্য ও সুপারিশ করেছে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) একটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্য পরিমাপক হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল, যা আর্থিক দারিদ্র্য পরিমাপের একটি মূল্যবান পরিপূরক হিসেবে কাজ করে এবং এসডিজি লক্ষ্য ১ ট্র্যাক করার জন্য একটি সূচক হিসেবে কাজ করে।

প্রথমবারের মতো আনুমানিক জাতীয় এমপিআই, বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ওপর একটি সামগ্রিকভাবে জাতীয়, বিভাগীয় এবং জেলা পর্যায়ে মূল্যায়ন করেছে। এই এমপিআই ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে। এমপিআই দারিদ্র্যের অনুমানের একটি অতিরিক্ত সূচক হতে পারে বলে জানিয়েছে জিইডি। ২০৩০ সালের এজেন্ডায়, এসডিজি লক্ষ্যে স্পষ্টভাবে দারিদ্র্য পরিমাপে বহুমাত্রিকতার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক দিক বিবেচনা করে, যেমন-স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মানের তথ্য নেওয়া হয়েছে।

এই পরিমাপে বিশ্বব্যাপী অনুসরণ করা ১০টি সূচক বিবেচনা করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি অতিরিক্ত সূচক, ‘ইন্টারনেট অ্যাক্সেস’। এই প্রকাশনাটিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ইউনিসেফ, অক্সফোর্ড মাল্টিডাইমেনশনাল পোভার্টি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (ওপিএইচআই) এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদেরসহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অংশীজনদের সহায়তা নেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্রতম ব্যক্তিরা একাধিক বঞ্চনার শিকার। বহুমাত্রিক দরিদ্ররা বেশির ভাগই আবাসন মানের দিক থেকে বঞ্চিত, যার মধ্যে রয়েছে অনুন্নত মেঝে, ছাদ বা দেয়াল। এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের অভাব, উন্নত স্যানিটেশন পরিষেবার অভাব এবং নির্দিষ্ট তালিকার চেয়ে কম সম্পদের মালিকানা।

এমপিআই প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের প্রতি চারজনে একজন (২৪.০৫ শতাংশ) মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্য (এমপিআই)। প্রায় ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ব্যক্তি বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সম্মুখীন। গ্রামীণ এলাকার মানুষের হার শহরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বহুমাত্রিক দরিদ্রতায় গ্রাম এলাকার ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ মানুষ, যেখানে শহরাঞ্চলের মানুষ ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

Manual7 Ad Code

বিভাগ এবং জেলাজুড়ে দরিদ্র মানুষের অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। সব বিভাগের মধ্যে সিলেটে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার সর্বোচ্চ, যার হার ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। তা ছাড়া ৬৪টি জেলার মধ্যে পাঁচ জেলার বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বান্দরবান, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ, রাঙামাটি এবং ভোলার ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। প্রাপ্তবয়স্কদের (২১ দশমিক ৪৪ শতাংশ) তুলনায় শিশুদের (২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ) মধ্যে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার বেশি।

জিইডি ২০২৫ সালে এসে ২০১৩ সালের তথ্য দিয়ে জানিয়েছে দারিদ্র্যের হার কমেছে। সংস্থাটি বলছে, ২০১২-১৩ সালে পরিচালিত এমআইসিএস জরিপ অনুযায়ী, দেশের দারিদ্র্যের হার কমেছে। ওই বছর দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ দশমিক ৬৫ শতাংশ এমপিআই দরিদ্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, কিন্তু ২০১৯ সালের মধ্যে, এই অনুপাত প্রায় এক-চতুর্থাংশ অথবা জনসংখ্যার ২৪.০৮ শতাংশে নেমে এসেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও, বাংলাদেশে এমপিআই দরিদ্র ব্যক্তির প্রকৃত সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে এসেছে। ২০১৩ সালের বহুমুখী দারিদ্র্য ছিল ৬ কোটি ৫৫ লাখ ১০ হাজার। ২০১৯ সালে তা নেমে এসেছে ৩ কোটি ৯৮ লাখ ২০ হাজারে। এই বছরগুলোর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৫৬ লাখ ৮০ হাজার মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে।

জাতীয় এমপিআই অনুসারে, বাংলাদেশের শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী। ০-৯ বছর বয়সি শিশুরা ১০-১৭ বছর বয়সি শিশুদের মতোই বহুমাত্রিকভাবে দরিদ্র হওয়ার সম্ভাবনা বেশি (২৮.৬ শতাংশ বনাম ২৮.৮ শতাংশ)। এ ক্ষেত্রে জিইডি সুপারিশ করেছে, দরিদ্রতম জেলাগুলোর শিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য, সরকারি সহায়তার লক্ষ্য আবাসন ব্যবস্থার উন্নতি, নিরাপদ পানীয় জলের অ্যাক্সেস প্রদান, স্যানিটেশন সুবিধা উন্নত করা এবং পরিষ্কার রান্নার জ্বালানির ব্যবহার প্রচার করা।

Manual8 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code