প্রজন্ম ডেস্ক:
চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বরাবরই পিছিয়ে। ‘অনেক দামে’ চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সক্ষমতা অর্জন হলেও জ্বালানি সংকটে চাহিদামতো উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিদ্যুতের উৎপাদনটা পারমাণবিকে গেলেই চাহিদা আর উৎপাদন অনেকটাই সমান্তরালভাবে চলবে। আর কম দামে অনেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে খুব বেশি দিন দেরি করতে হবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছরের শেষ নাগাদ বিদ্যুতের আলো ফুটবে পারমাণবিক শক্তিতে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক মো. কবীর হোসেন বলেন, ‘আশা করছি, এ বছরের শেষ দিকে অথবা আগামী বছরের শুরুতেই প্রথম ইউনিট থেকে “পাওয়ার স্টার্টআপ” বা বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। এরপর ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়িয়ে পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।’
বিদ্যুতের পারমাণবিক যাত্রা মসৃণ করতে আর্থিক দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প নিতে হয়েছে। ব্যয় বা সময় বৃদ্ধির মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে যত নেতিবাচক শব্দ আছে, এর সবই এখানে আছে। এ পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বৈশ্বিক করোনা মহামারী। আর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা যেন এ প্রকল্পে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সব সমস্যা দূর করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এখন চলছে শেষ সময়ের ছোঁয়া। প্রস্তুতিমূলক ধাপে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাইপলাইন ও যন্ত্রপাতিকে ধুলাবালি, তেল, ওয়েল্ডিংয়ের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করা হচ্ছে। পানি, বিশেষ রাসায়নিক বা বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে। সিস্টেম স্থাপনের পর পরিষ্কার করা হচ্ছে। এরপর বিভিন্ন পাইপলাইন ও যন্ত্রপাতির ওপর হাইড্রোলিক পরীক্ষা করা হবে, যার উদ্দেশ্য এগুলোর দৃঢ়তা পরীক্ষা করা। এ ছাড়া কোথাও কোনো লিকেজ বা ফাটল আছে কি না, তা যাচাই করা। এ কাজ শেষে আরও কিছু পরীক্ষা চালানো হয়, যেগুলোর মধ্যে কিছু একক যন্ত্রপাতির পরীক্ষা এবং কিছু সমন্বিত সিস্টেম পরিচালনা ও নকশাগত পরীক্ষার বিষয় থাকে। এগুলো করে নিশ্চয়তা দেওয়া হয় যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিরাপদ, কার্যকর এবং আন্তর্জাতিক মানসম্মত। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইইএ) এসব কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি উচ্চপ্রযুক্তির এবং নিরাপত্তানির্ভর প্রকল্প। প্রতিটি ধাপ সুপরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়, যাতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কম হয় ও সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। রূপপুরে প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষে এখন কমিশনিংয়ের প্রস্তুতি হিসেবে চূড়ান্ত পর্যায়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে নিখুঁতভাবে। কারণ এ ধাপেই নিশ্চিত করা হয় যে কেন্দ্রটি নিরাপদ, কার্যকর ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। বর্তমানে আইএইএর একটি প্রতিনিধিদল প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছে। ২৭ আগস্ট পর্যন্ত কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও অন্যান্য নানা বিষয় পরিদর্শন করবে। এরপর অনুমতি মিললে সুবিধাজনক সময়ে প্রথম ইউনিটে জ্বালানি লোড করা হবে। এই জ্বালানি লোড করার পর সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে লাগবে প্রায় ৯০ দিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ আমাদের জন্য অনেক মর্যাদার। নানা রকম নিরাপত্তা মেনেই এ ধরনের কেন্দ্র নির্মিত হয়। এরপরও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ভালোভাবে নিশ্চিত করা জরুরি। সে ক্ষেত্রে ‘ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম এবং সেন্টার’ বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও অমূলক ভয় কাটানোর জন্যও নানা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’
গুরুত্বপূর্ণ যেসব পরীক্ষা শেষ হয়েছে : রি-অ্যাক্টরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের হার্ট বা হৃদয় বলা হয়। যেখানে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপই পরে পানিকে বাষ্পে রূপান্তরিত করে টারবাইন ঘোরাতে সাহায্য করে, যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। রিঅ্যাক্টর নিরাপদে চালানোর জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকে।
এ ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্পে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর একটি হলো রি-অ্যাক্টর ভবনের প্রতিরক্ষামূলক আবরণের (কনটেইনমেন্ট) ঘনত্ব ও দৃঢ়তা পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় যাচাই করা হয় রি-অ্যাক্টর ভবন, কনটেইনমেন্ট কাঠামো এবং অন্য অংশগুলো সঠিকভাবে নির্মিত হয়েছে কি না। যদি কোথাও লিকেজ বা ছিদ্র, ফাটল বা দুর্বলতা থাকে, তা এই পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়, ভবিষ্যতে কোনো রেডিয়েশন বাইরে ছড়ানোর ঝুঁকি থাকবে না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হলো ‘কোল্ড ও হট টেস্টিং’। এই পরীক্ষাগুলো পারমাণবিক জ্বালানি লোড না করেই, ডামি কোর (পারমাণবিক জ্বালানির আদলে তৈরি নকল জ্বালানি) ব্যবহার করে চালানো হয়।
কোল্ড টেস্টিং পর্যায়ে, রি-অ্যাক্টরের প্রাইমারি কুলিং সার্কিটে হাইড্রোলিক পরীক্ষা (পানির চাপে পরীক্ষা) ও সার্কুলেশন ফ্লাশিং (পানি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চালানো) করা হয় এবং বিভিন্ন পাওয়ার ইউনিট সিস্টেম, যার মধ্যে সেফটি (নিরাপত্তা) সিস্টেমও রয়েছে, তা একযোগে পরীক্ষা করা হয়। হাইড্রোলিক পরীক্ষায় ডিওনাইজড (আয়রনমুক্ত) ঠান্ডা পানি সরবরাহ করা হয় প্রাইমারি সার্কিটে এবং বিভিন্ন স্তরের চাপে পাইপলাইনগুলো পরীক্ষা করা হয়। উদ্দেশ্য হলো, লিকেজ বা ছিদ্র খোঁজা এবং নিশ্চিত হওয়া যে পাম্প, ভালভ ইত্যাদি ঠিকভাবে কাজ করছে।
এ ছাড়া, প্রাইমারি সার্কিটের জন্য উচ্চচাপ সহনশীলতার পরীক্ষা চালানো হয় দেড়গুণ অতিরিক্ত চাপে। এর উদ্দেশ্য হলো, সার্কিটের সব যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা বা দৃঢ়তা যাচাই করা।
ওপরের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাসহ আরও বেশ কিছু পরীক্ষা ইতিমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে সম্পন্ন হয়েছে।
মূল যন্ত্রপাতির পুনঃপরীক্ষণ : হট টেস্টিং শেষ হওয়ার পর শুরু হবে ‘রিভিশন’ বা পুনঃপরীক্ষা পর্যায়। এ পর্যায়ে প্রতিটি যন্ত্রপাতি একে একে খুলে আলাদাভাবে পরীক্ষা করা হবে। এ সময় রি-অ্যাক্টরের ঢাকনা (লিড) খোলা হবে এবং ভেতরের প্রতিটি উপাদান একে একে পরীক্ষা করা হবে।
বিশেষ প্রক্রিয়ায় মূল যন্ত্রপাতি, ওয়েল্ড জয়েন্ট, স্টাড, নাট এবং এর সংযোগগুলো পরীক্ষা করা হয়। যদি কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তা সংশোধন এবং পরে ছোট পরিসরে আবার পরীক্ষা করা হবে।
এ পর্যায়ে এটাও যাচাই করা হয় যে ভালভগুলো সঠিকভাবে খুলছে ও বন্ধ হচ্ছে কি না, তাপমাত্রার কারণে কোনো অংশ বিকৃত হয়েছে কি না, পাইপ সংযোগে কোনো লিকেজ বা ফাটল দেখা দিয়েছে কি না।
জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযোগ
মূলত বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংযোগের আগে এর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সব বৈদ্যুতিক সংযোগ, কেবল, ট্রান্সফরমার, সুইচগিয়ার, রিলে প্রটেকশন এবং নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়, যেগুলো ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে।
এই পরীক্ষায় যাচাই করা হয় যে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো বাধা আছে কি না, সিস্টেমে শর্টসার্কিট কিংবা ওভারলোডের ঝুঁকি আছে কি না এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালনার জন্য মূল ও বিকল্প পাওয়ার (জেনারেটর, ইউপিএস, স্ট্যান্ডবাই ব্যাটারি) লাইন ঠিকভাবে কাজ করছে কি না।
জ্বালানি লোডিং এবং ফিজিক্যাল স্টার্টআপ
সব প্রস্তুতি শেষে রাশিয়া থেকে সরবরাহ করা ১৬৩টি ফুয়েল অ্যাসেম্বলি (ইউরেনিয়াম) রি-অ্যাক্টর কোরে স্থাপন করা হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘জ্বালানি লোডিং’। এটি করতে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অনুমোদন লাগবে।
অব্যবহৃত বা নতুন পরমাণু জ্বালানি প্রায় অতেজস্ক্রিয় বা তেজস্ক্রিয়তাহীন এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করা হলে এটি বিপজ্জনক নয়। পারমাণবিক এই জ্বালানি বিশেষ প্রক্রিয়ায় রূপপুর প্রকল্প এলাকায় অত্যন্ত নিরাপদে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এখন সেখান থেকে রি-অ্যাক্টর ভবনের একটি বিশেষ ফুয়েল স্টোরেজ পুলে নিয়ে যাওয়া হবে এই জ্বালানি। এর তা রি-অ্যাক্টরে লোড করা হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন
রি-অ্যাক্টরে জ্বালানি লোডিং এবং প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ‘পাওয়ার স্টার্টআপ’ বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সূচনা শুরু হবে। এই পর্যায়ে, রি-অ্যাক্টর কোরে ইউরেনিয়াম বিভাজনের মাধ্যমে ধারাবাহিক নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া শুরু করে ধাপে ধাপে রি-অ্যাক্টরের ক্ষমতা ১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করা হবে। এতে বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত তাপ রি-অ্যাক্টরের প্রাইমারি সার্কিটের পানি গরম করবে। এই গরম পানি স্টিম জেনারেটরে প্রবেশ করে যেখানকার হিট এক্সচেঞ্জ টিউবের মাধ্যমে সেকেন্ডারি সার্কিটের পানিকে বাষ্পে রূপান্তরিত করবে এবং তা আবার রি-অ্যাক্টরে ফিরে আসবে। প্রথম ও দ্বিতীয় সার্কিটের বিস্তৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষাও এ সময় সম্পন্ন হবে।
আর এসব পরীক্ষা শেষে রি-অ্যাক্টরের ক্ষমতা প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হবে এবং উৎপন্ন বাষ্প টারবাইনে প্রবেশ করানো হবে, যার মাধ্যমে টারবাইন চালু করা হবে। টারবাইন থেকে নির্গত বাষ্প কনডেন্সারে প্রবেশ করে, যেখানে তৃতীয় কুলিং সার্কিটের পানি, যা কুলিং টাওয়ারের মাধ্যমে ঠান্ডা থাকে, সেটি হিট এক্সচেঞ্জ টিউবের মাধ্যমে বাষ্পকে তরলে রূপান্তরিত করবে। অর্থাৎ পানি থেকে বাষ্পে রূপান্তর হয়ে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পরে কুলিং টাওয়ারের মাধ্যমে সেই বাষ্প আবার পানিতে পরিণত হয়ে আবার ব্যবহার হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে। এভাবেই চলতে থাকবে।
টারবাইন চালু হওয়ার পর টারবাইন ও জেনারেটরের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা হবে। এরপর জেনারেটরকে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সিনক্রোনাইজ বা সংযুক্ত করা হবে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস, কয়লা কিংবা অন্যান্য জ্বালানির মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অতি দ্রুত পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে যেতে পারে না। কারণ নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। সেজন্য জ্বালানি লোড করার পর আস্তে আস্তে উৎপাদন বাড়িয়ে পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে প্রায় ১০ মাস সময় লাগে। দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন কী আগামী বছরে শুরু হবে? এমন প্রশ্নের জবাব সরাসরি না দিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. কবীর হোসেন বলেন, প্রথম ইউনিট শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় ইউনিট নিয়ে মন্তব্য করা যাবে। তবে নিরাপত্তা ও গুণগত মান নিশ্চিত করে সব কাজ দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে।
Sharing is caring!