প্রজন্ম ডেস্ক:
এশিয়া মহাদেশে যেন গণঅভ্যুত্থানের জোয়ার উঠেছে। দেশে দেশে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। সরকার পতনের শুরুটা হয়েছিল ২০২২ সালে কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পতনের মধ্য দিয়ে। তুমুল বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দ্বীপরাষ্ট্রটি। তীব্র মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, বিদ্যুৎবিভ্রাট থেকে জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি ইত্যাদি কারণে নানামুখী সংকটে জর্জরিত হয়ে পড়ে দেশটি। তারই বিরোধিতায় শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান। গোটাবায়া রাজাপাকসে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর ২০২৪ সালে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারকে উৎখাতে রাস্তায় নামে লাখ লাখ মানুষ। শুরুতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে কোটার বিরুদ্ধে।
সেই কোটাবিরোধী আন্দোলনে স্বৈরাচার হাসিনার নির্দেশে নির্মম বর্বরতা চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলত সাধারণ কোটাবিরোধী আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ভোটচুরি, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, বৈষম্য ইত্যাদির প্রতিবাদে তীব্র জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান হাসিনা। এরপর ২০২৫ সালে চলতি সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দোনেশিয়ায়ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও সেখানে এখনও সরকার পতনের মতো ঘটনা ঘটেনি। এর পরের বিক্ষোভটা নেপালি তরুণ প্রজন্মের। শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের মতো নেপালের প্রধানমন্ত্রীকেও পদ ছাড়তে হয়েছে। নেপালের তরুণরা ক্ষেপে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের পর।
দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতিসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে অলি সরকারের বিরুদ্ধে। সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করে কৌশলে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা হচ্ছিল বলে অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে। আর তাতেই ক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলো একটি বড় প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করছে। আর তা হলো- এ অঞ্চলের তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতি, দমননীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নতুন শক্তি হয়ে উঠছে।
নেপালের অস্থিরতা শুরু হয় এক সরকারি সিদ্ধান্ত থেকে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন সরকার ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেয়। যুক্তি দেওয়া হয়, এই প্ল্যাটফর্মগুলো নেপালে রেজিস্ট্রেশন করেনি। তবে জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, কারণ প্রায় দেড় কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী ও কয়েক কোটি মানুষ জীবিকা ও ব্যবসার জন্য এসব মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। তরুণ প্রজন্ম এই সিদ্ধান্তকে শুধু কণ্ঠরোধ নয়, বরং কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার প্রতিফলন হিসেবে দেখেছে। ফলে রাস্তায় নেমে আসে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, যারা ‘আমাদের প্রজন্মেই পরিবর্তন ঘটতে হবে’ সেøাগানে একত্রিত হয়। নেপালে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ আগেই জমে উঠেছিল। গত সপ্তাহে সরকার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব এবং এক্সসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করার পর সেই ক্ষোভ রাস্তায় ফেটে পড়ে। এই পদক্ষেপ মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়ে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আন্দোলন কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নয়। ভেতরে জমে ছিল বহু বছরের হতাশা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৪ সালে নেপালে তরুণদের বেকারত্বের হার ছিল ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশের জিডিপির এক-তৃতীয়াংশের বেশি রেমিট্যান্সনির্ভর। অর্থাৎ লাখ লাখ তরুণ চাকরির আশায় বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। এরই মধ্যে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে সাধারণ তরুণদের ক্ষোভ আরও উসকে দেয়। এভাবে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও বৈষম্যের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধকরণ মিলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। এক বিক্ষোভকারীকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, সব নেপালি নাগরিক দুর্নীতিতে ক্লান্ত। প্রতিটি তরুণ দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই আমরা চাই আমাদের তরুণদের রক্ষা করতে এবং দেশের অর্থনীতি উন্নত করতে।
নেপালি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে আসা খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সরকারের ভুল সিদ্ধান্তই নেপালি ‘জেনারেশন জেড’ তথা জেন-জির ক্ষোভকে ফেটে বেরোতে সাহায্য করে। নেপাল সরকার গত বৃহস্পতিবার একযোগে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, লিংকডইন, রেডিটসহ ২৬টি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেয়। কারণ- এই কোম্পানিগুলো নেপালের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে রেজিস্ট্রেশন করেনি। ২৮ আগস্ট থেকে তাদের এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল আবেদন জমা দেওয়ার জন্য। সুপ্রিম কোর্টের আগের নির্দেশ অনুযায়ী, প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিকে নেপালে প্রতিনিধি নিয়োগ, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ও কমপ্লায়েন্স অফিসার রাখতে হতো। টিকটক, ভাইবার, উইটক, নিমবাজ, পপো লাইভ শর্ত মানায় চালু আছে। টেলিগ্রাম আর গ্লোবাল ডায়েরির আবেদন এখনও প্রক্রিয়াধীন। সরকার বলছে, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য ভুয়া খবর, অনলাইন প্রতারণা আর অর্থ পাচার ঠেকানো।
সরকারি যুক্তি এক জিনিস, কিন্তু বাস্তবে মানুষের প্রতিক্রিয়া পুরো ভিন্ন। নেপালে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী ৩৬ লাখ। অনেকেই ব্যবসা, শিক্ষা আর জীবিকার জন্য এসব প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউজান রাজভান্ডারি বলেছেন, প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ, কিন্তু আসল ক্ষোভ দুর্নীতি নিয়ে। তার ভাষায়, নেপালে দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ২০ বছর বয়সি ছাত্রী ইক্ষামা তুমরোক বলেছেন, আমরা সরকারের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি। পরিবর্তন চাই। আগের প্রজন্ম হয়তো সহ্য করেছে, কিন্তু আমাদের প্রজন্মেই এর শেষ হতে হবে। ভিডিওতে আরেক বিক্ষোভকারীকে বলতে শোনা গেছে, নেতাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়? তাই এটা স্পষ্ট যে, সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করা ছিল কেবল ট্রিগার। ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভের মূল কারণ দুর্নীতি, বেকারত্ব আর ক্ষমতাসীনদের প্রতি বৈষম্যের অনুভূতি।
নেপালের বিক্ষোভ রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে শুরু হয়ে আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহরে। বানেশ্বর, সিংহদরবার, নারায়ণহিতি ও আশপাশে কারফিউ জারি করা হয়। পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছোড়ে। বিক্ষোভ সহিংস হলে কমপক্ষে ১৯ জন নিহত এবং ৩ শতাধিক আহত হয়। সোমবার রাতেই দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক পদত্যাগ করেন। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। নেপালে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করা তরুণদের জীবনে সরাসরি আঘাত করেছে। কিন্তু এর পেছনে জমা থাকা ক্ষোভ- দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদ, বেকারত্ব আর বৈষম্য- এসব কিছুর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে রাস্তায়। তাই আন্দোলনটা কেবল সোশ্যাল মিডিয়া ইস্যু নয়, এটা এক প্রজন্মের রাজনৈতিক আর্থিক মুক্তির দাবি।
বাংলাদেশের তরুণরা ২০২৪ সালে সংসদ ঘেরাও করে, বৈষম্য, দুর্নীতি ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। নেপালের তরুণ প্রজন্মও প্রায় একই পথ নিয়েছে। এর আগেই শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে যুবসমাজ প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে পড়েছিল। সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশেই ছাত্র-যুবসমাজ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগঠিত হচ্ছে, আবার প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করছে। নেপালের আন্দোলন তাই শুধু এক দেশের সংকট নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের এক বৃহত্তর জাগরণের অংশ। দুর্নীতি, বৈষম্য, দমননীতি- এসবের বিরুদ্ধে তারা আপসহীন। সরকারের ভুল সিদ্ধান্তই তাদের ক্ষোভকে ফেটে বেরোতে সাহায্য করে। শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশ হয়ে নেপাল। এই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে অন্য সরকারপ্রধানদেরও নাড়া দিতে পারে।
Sharing is caring!