প্রজন্ম ডেস্ক:
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণাকে চূড়ান্ত ধরেই সকল প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সরকারের পক্ষ থেকে একই দিন গণভোট আয়োজনেরও প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে ইসিকে। চলছে গণভোটের আইন প্রণয়নের কাজ। সংসদ ও গণভোট একই দিনে করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসায় ইসিকে বাড়তি কিছু প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। এবার নির্বাচনের কমপক্ষে ৬০ দিন সময় হাতে রেখে তফসিল দেওয়ার প্রস্তুতি রাখছে ইসি। সেই হিসাবে আগামী ৪ কিংবা ৭ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতিতে রয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। আর সম্ভাবনা রয়েছে আগামী বছরের ৫ অথবা ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ঘোষণা আসার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পাশাপাশি আসন সমঝোতা করে জোট গঠনের আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে দলগুলো। জোট ও দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচনী কার্যক্রম ও প্রচারাভিযান শুরু করলেও কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা এবং সংশয়ের কথাও বলছেন। এই সংশয় ও শঙ্কা থেকে বেরিয়ে আসতে ইসির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে তফসিলের তারিখ ঘোষণার দাবিও তোলা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সবার চোখ এখন নির্বাচনী তফসিলের দিকে। সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখের কথা না বললেও ইসি সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দুটি তারিখের যেকোনো একদিন তফসিল ঘোষণার জোর ইঙ্গিত মিলছে।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন ধরে নিয়ে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে এসে একই দিনে গণভোট যুক্ত হওয়ায় নতুন রোডম্যাপ করতে হচ্ছে ইসিকে। তবে এরই মধ্যে ইসি তার রুটিন কাজ অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন কাজ শেষ করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ চলমান রয়েছে। আগামী ২৫ নভেম্বর ৮১ পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া ২৭ নভেম্বর আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে আবারও সংলাপে বসবে ইসি। নভেম্বরের মধ্যেই এসব কাজ গুছিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
নির্বাচন পরিচালনা শাখা এবং জনসংযোগ শাখা সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৭ নভেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করার পরিকল্পনা নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক বৈঠক করবেন সিইসি। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ বাহিনী প্রধান ও সংস্থা, বিভাগের প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ৩০ নভেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়োগ, পরিকল্পনা, সমন্বয় ও দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা করার সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগের প্রধানদের নিয়ে এ বৈঠক হবে।
অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার সরকারের পক্ষ থেকে গণভোটের প্রস্তুতি নিতে ইসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর এখন ইসি গণভোটের আইনের অপেক্ষায় রয়েছে। একই দিনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তুতি নিতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে জানিয়ে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সামনের সপ্তাহে গণভোট আইন করা হবে। আইন হয়ে গেলে গণভোটের প্রস্তুতি শুরু করবে কমিশন।’
এদিকে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বার বার আশ্বস্ত করা হলেও ভোট নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে নানা শঙ্কা প্রকাশিত হচ্ছে। তাই ভোট নিয়ে ‘শঙ্কা’ কাটাতে ইসির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে তফসিল ঘোষণার দাবিও উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত বৈঠকের পরে সেটি জানানোর সম্ভাবনা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দুটি সভার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে ডিসেম্বরের কোন তারিখে তফসিল ঘোষণা করা হবে তা ঠিক করবেন সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনাররা।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘তফসিলের প্রস্তুতির বিষয়টি হচ্ছে, গণভোট হতে গেলে আইন হতে হয়। নির্বাচন কমিশনের কাছে আইনের মাধ্যমে এখতিয়ারটা আসতে হয়। আমরা গণভোটের আইনের অপেক্ষায় রয়েছি। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে তফসিলের সময়টায় (তফসিল ঘোষণা থেকে ভোটের তারিখ) দুই মাসের গ্যাপ রাখা।’
ইসি সূত্রে জানা গেছে, বাগেরহাটের আসন পুনর্বহালের রায় এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত আরও প্রায় ৩০টির বেশি আবেদন আদালত পর্যন্ত যাওয়ায় প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনের সময় সীমানা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, আদেশের কপি (সার্টিফায়েড কপি) পেলে করণীয় ঠিক করবে কমিশন। তবে সংসদীয় আসনবিষয়ক জটিলতার মীমাংসায় দেরি হলে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় প্রভাব পড়বে। গণভোট ও সীমানা জটিলতা না কাটলে এর প্রভাব পড়তে পারে তফসিলে। তবে ঘোষিত সম্ভাব্য সময়ে নির্বাচন করতে হলে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা না হলেও প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। কমিশনও সেটা চায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংসদ নির্বাচনের জন্য পৌনে ১৩ কোটি ভোটার ও প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার বিবেচনায় রেখে ব্যালট পেপার মুদ্রণের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। প্রায় ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার ভোটকক্ষ থাকবে। ৯-১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা আর ৭-৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকবে ভোটে। ইসির নির্দেশনায় রিটার্নিং অফিসারের তত্ত্বাবধানে ৩০০ আসনে সার্বিক নির্বাচন পরিচালনা হয়। তবে এবার প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে। দেশে ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে তিনটি গণভোট হয়েছে। কিন্তু কখনও জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হয়নি। গণভোটে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আছে এমন কর্মকর্তারা বলেন, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে ভোটকক্ষ বাড়ানো, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আর ভোটার সংখ্যা অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ সরঞ্জামাদি বাড়াতে হবে গণভোটের জন্য। প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের বিষয়টিও রয়েছে। গণভোট নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর বিষয় রয়েছে। নির্বাচনী ব্যয়ও ২০ শতাংশের বেশি বাড়বে। গণভোট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি ও বিধি প্রণয়নের পরই সার্বিক বিষয়ে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যাবে।
তফসিলের দিকে তাকিয়ে দলগুলো
নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে ইসি। সেই সংলাপে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হলো আপনারা কবে তফসিল ঘোষণা করবেন, সেটা নির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষণা করুন। যেমন আজ আইসিটি ট্রাইব্যুনালে একটি রায়ের তারিখ ঘোষণা হয়েছে; তেমনি নির্বাচন কমিশনও যদি তফসিল ঘোষণার তারিখ জানায়, তাহলে জনগণ আশ্বস্ত হবে।’
একই দিন সংলাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল ক্বাফি রতন বলেন, নির্বাচন কমিশনারের প্রতি অনুরোধ, আপনি অন্তত জানিয়ে দিন নির্বাচনের তফসিল কোন সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে। নির্দিষ্ট তারিখ না বললেও সপ্তাহটি উল্লেখ করলে জনগণের অনিশ্চয়তা দূর হবে এবং আস্থা ফিরে আসবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাইফুল হক বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বার বার ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের কথা বললেও জনগণের মনের মধ্যে থেকে দ্বিধা-সন্দেহ যাচ্ছে না। এই অবস্থায় কমিশনের পক্ষ থেকে তফসিলের একটা তারিখ ঘোষণা হলে আস্থাহীনতা কেটে যাবে। নির্বাচন নিয়ে মানুষের সংশয় দূর হবে।’
নির্বাচন ও জোট নিয়ে তৎপর দলগুলো
নির্বাচন নিয়ে সরকারের ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী তৎপরতা বেড়েছে। দলীয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে ছোটবড় দলগুলো জোট শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণতন্ত্র মঞ্চের বিভিন্ন শরিক দল, আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। দলগুলোর নেতারাও প্রচার তৎপরতার পাশাপাশি জোট গঠনের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছেন।
সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীÑ এই দুই দলের সঙ্গে এনসিপির জোট গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল রবিবার কথা বলেছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘অনেক ধরনের গুঞ্জন ও মিথ্যা সংবাদ’ প্রচার করে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) একদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তারা এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কোনো ধরনের ক্ষমতার জন্য, আসনের জন্য তারা কারও সঙ্গে কোনো সমঝোতা করবেন না। এনসিপি যদি একটি আসনও না পায়, তবু তার আদর্শ, নীতি ও লক্ষ্যে অটুট থাকবে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ৬ থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত দলীয় মনোনয়নপত্র বিক্রি শেষে গতকাল এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে এনসিপির কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। সংবাদ সম্মেলনের পর একই সেন্টারে ৩০০ আসনের জন্য দলটির মনোনয়নপত্র নেওয়া ১ হাজার ৪৮৪ জন প্রার্থীর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করে এনসিপি।
এদিকে ক্ষমতার জন্য, আসনের জন্য কারও সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা করা হবে না মর্মে এনসিপির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলেও একই দিন দলটির সঙ্গে জোটের সম্ভাবনার কথা জানান আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন জোট গঠন করা হবে। জোটে এবি পার্টির সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল থাকবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দল হিসেবে যারা সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছে, তাদের নিয়ে এই জোট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদের।’
বিষয়টির সত্যতা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের একটি শরিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা। তিনি বলেন, ‘এমন একটা চেষ্টা আছে। তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আমাদের দলেরও এই জোটে থাকার সম্ভাবনা আছে।’ চূড়ান্ত হওয়ার আগেই বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন ওই নেতা।
Sharing is caring!