প্রজন্ম ডেস্ক:
একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট- দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এই আয়োজন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও মাঠ প্রশাসনের ওপর চাপ কয়েক গুণ বেড়েছে। কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা ও অতিরিক্ত লজিস্টিক থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি, প্রশিক্ষণ, ব্যালট ছাপা, নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন- সব মিলিয়ে ইসির জন্য এগুলো সবচেয়ে বড় সমন্বিত কার্যক্রম। এই সমন্বয়ের কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ইসি সচিবালয়, নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এখন প্রশ্ন উঠেছে, বৃহৎ সমন্বিত কার্যক্রমের জন্য ইসি কতটা প্রস্তুত? সংস্থাটির মাঠ প্রশাসন কতটা দক্ষতার সঙ্গে এই দ্বৈত ভোট পরিচালনা করতে পারবে। ইসি ও প্রশাসন যদি এটি দক্ষভাবে সামলাতে পারে, এটি হবে দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক। অন্যদিকে তাদের সামান্য ভুল দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক বিতর্কের সূচনা করতে পারে।
ইসি সচিবালয়ের তথ্যমতে, দুই নির্বাচন একসঙ্গে করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ভোট সরঞ্জাম কেনাকাটা, লজিস্টিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চলছে নির্বাচন কর্মকর্তাদের রদবদল, প্রশিক্ষণ এবং সমন্বয় সভা, যাতে মাঠ প্রশাসন দক্ষ ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। কেন্দ্র ও বুথ পর্যায়ে ভোটকেন্দ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ব্যাপক মোবিলাইজেশন করছে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিশ্লেষকরা ভোটের পরিবেশ রক্ষায় বর্তমান ইসির সক্ষমতা নিয়ে এখনো সংশয়ে আছেন। ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলীর মতে, প্রশাসন, নিরাপত্তা ও লজিস্টিক- এই তিন দিকেই ইসির ওপর অতিরিক্ত চাপ রয়েছে। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন প্রশাসন, নিরাপত্তা এবং লজিস্টিকের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। তবে রাজনীতিবিদসহ অংশীজনদের সহযোগিতায় কমিশন লক্ষ্য পূরণে আশাবাদী।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে রদবদল ও প্রশিক্ষণ
নির্বাচন আয়োজনে ইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো মাঠ প্রশাসন- ডিসি, ইউএনও, রিটার্নিং অফিসার ও পোলিং অফিসাররা। ভোটের মাঠে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন স্তরের পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি বা রদবদল করা হয়েছে। এসবের লক্ষ্য নিরপেক্ষতার মান বজায় রাখতে অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন, জেলায় জেলায় ভোট ব্যবস্থাপনায় নতুন দল তৈরি, নতুন কর্মকর্তাদের হাতে প্রযুক্তিভিত্তিক ট্রেনিং মডিউল তৈরি।
অন্যদিকে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন- নতুন কর্মকর্তা বড় নির্বাচনে অনভিজ্ঞ। দুই ধরনের ভোট পরিচালনায় জটিলতা বোঝার সময় বেশি। ভুল সিল, ভুল ব্যালট বাক্স বা ভুল গণনার ঝুঁকি বৃদ্ধি। মাঠে প্রায় ৯-১০ লাখ নির্বাচন কর্মকর্তা কাজ করবেন। তাদের প্রশিক্ষণ- আইনি কাঠামো, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা, ভোট গ্রহণ এবং দ্বৈত গণনা প্রক্রিয়া এই চার ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গণভোটের হ্যাঁ-না ভিত্তিক গণনা ভুলের ঝুঁকি বেশি। তাই প্রশিক্ষণই এবারের নির্বাচনের মেরুদণ্ড।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোবিলাইজেশন
দুটি ভোট একসঙ্গে হওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইসি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ বৈঠকে ব্যয়সাপেক্ষ একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রস্তাব হয়েছে- ড্রোন নজরদারি নিষিদ্ধকরণ, দেশকে রেড-ইয়েলো-গ্রিন জোনে ভাগ, ভোটের আগে-পরে সাত-আট দিনব্যাপী মাল্টিলেভেল মোতায়েন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দ্রুত-প্রতিক্রিয়া বাহিনী এবং পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় ভোট সরবরাহের বিশেষ চেইন ব্যবস্থা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, একই দিনে দুটি ফল প্রকাশ হলে রাজনৈতিক উত্তাপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, একই দিনে দুই ভোট পরিচালনার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পূর্ণ প্রস্তুত। নির্বাচনকালীন ৯ দিন বিশেষ মোবাইল বাহিনী মাঠে থাকবে, যাতে প্রতিটি কেন্দ্র নিরাপদ থাকে। তিনি বলছেন, যেকোনো বিশৃঙ্খলাকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা ও উপজেলায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়কে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার মূল কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোট শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।
ভোটের পরিবেশ রক্ষায় ইসির সক্ষমতা নিয়ে সংশয়
সম্প্রতি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ইসির নির্বাচনি সংলাপে একসঙ্গে দুই নির্বাচন ঘিরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইসির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে গণভোটের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশ হলে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিছু রাজনৈতিক নেতা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে ইসির সীমাবদ্ধতা ও কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি সমস্যা তৈরি করতে পারে।
ইসির অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ
কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা: প্রত্যেক ভোটার ১৫-৩০ সেকেন্ড বেশি সময় নিলে লাইনের চাপ, বুথে ভিড় এবং দিনের শেষে গণনায় বিলম্ব হতে পারে।
প্রচারণা ও গণভোট সচেতনতা: গ্রামীণ ও কম শিক্ষিত ভোটার বিভ্রান্ত হতে পারে, বিশেষ করে প্রশ্ন জটিল হলে।
দুটি ফল, দুটি ঝুঁকি: জাতীয় নির্বাচনের ফল দেরি হলে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়বে, গণভোটে ছোট ভুলও বিতর্ক তৈরি করতে পারে।
ব্যয় বৃদ্ধি: দ্বিগুণ ব্যালট, অতিরিক্ত বুথ, বাড়তি কর্মী ও নিরাপত্তা ব্যয় ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে।
আইনি জটিলতা: গণভোট আইন, ব্যালট নকশা ও প্রচারণা প্রোটোকল এখনো চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায়।
এ বিষয়ে নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বলেছেন, ‘প্রশাসন, নিরাপত্তা ও লজিস্টিক- তিন দিকেই ইসির জন্য বাড়তি চাপ; সামান্য ভুলও বড় রাজনৈতিক বিতর্কে রূপ নিতে পারে। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব হলেও প্রশাসনিকভাবে এটি একধরনের ‘স্ট্রেস-টেস্ট’। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সাধারণত একধরনের ভোট পরিচালনায় অভ্যস্ত; এবার একই কেন্দ্রে দুটি ব্যালট, আলাদা গণনা ও দ্বিগুণ কেন্দ্রব্যবস্থাপনা সামলাতে হবে। এতে ভোটার ম্যানেজমেন্টে চাপ বাড়বে- লাইন দীর্ঘ হবে, ভোটে সময় বেশি লাগবে এবং দিনের শেষে গণনায় বিলম্ব ঘটতে পারে। যেকোনো ছোট ভুলও বড় বিতর্ক ডেকে আনতে পারে। তিনি আরও বলেন, গণভোটের প্রশ্নসংক্রান্ত সচেতনতা কম হওয়ায় বাতিল ভোট বাড়ার সম্ভাবনা আছে। কিছু এলাকায় প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকিও বেশি। তাই গণভোটে দুর্বলতা হলে জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া লজিস্টিক চেইন, ব্যালট, বাক্স, সিল, পরিবহন- সবকিছুর ওপরই দ্বিগুণ চাপ পড়বে, কোথাও ঘাটতি হলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, ভোটকেন্দ্র চূড়ান্তকরণ, সরঞ্জাম বরাদ্দ ও মাঠ প্রশাসনের সমন্বয়সহ ৯০-৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন ও অনুমোদনের কিছু বিষয় প্রক্রিয়াধীন, তবে আশা করা হচ্ছে- ‘এ সপ্তাহেই বেশির ভাগ ঝুলে থাকা কাজ শেষ হবে।’
Sharing is caring!