প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৬শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

৮১ বছর পর কেন সেনাদের দেহাবশেষ নিয়ে যাচ্ছে জাপান

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ০১:৩৫ অপরাহ্ণ
৮১ বছর পর কেন সেনাদের দেহাবশেষ নিয়ে যাচ্ছে জাপান

Manual1 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

৮১ বছর পর কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি থেকে ২৪ জন সৈনিকের দেহাবশেষ নিয়ে যাচ্ছে জাপান। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে খননকাজ শেষ করা হয়। এগুলো এখন যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে জাপানে নেয়ার পর তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সেখানেই ‘যথাযথ মর্যাদায়’ সমাহিত করা হবে।

Manual2 Ad Code

 

জাপানের ফরেনসিক দলকে সহায়তাকারী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক বলেন, নির্ধারিত সময়ের দুদিন আগে ওয়ার সিমেট্রি (যুদ্ধসমাধি) থেকে ২৪ জন জাপানি সৈনিকের সমাধির খননকাজ শেষ হয়েছে। ৮১ বছর পরও সৈনিকদের কিছু কঙ্কাল, মাথার খুলি ও শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড় আমরা পেয়েছি। পুরো টিম এজন্য কঠোর শ্রম দিতে হয়েছে।

 

তিনি বলেন, প্রতিটি সমাধি কখনো যন্ত্রপাতি, কখনো হাতে সাবধানতার সঙ্গে খনন করতে হয়েছে। বিভিন্ন দেশে ৬০-৬৫ বছরের রেকর্ড থাকলেও আমার মনে হয় এবারই প্রথম দীর্ঘ এত বছর পর আমরা সমাধি খনন করে সৈনিকদের কিছু হাড় পেয়েছি। ২৪টি সমাধির মধ্যে ২৩টিতেই সৈনিকদের দেহাবশেষের বিভিন্ন অংশ মিলেছে। তবে একটি সমাধি থেকে কোনো আলামত মেলেনি।

 

তিনি আরও বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, যে সমাধিতে কোনো আলামত মেলেনি ওই সৈনিকের বয়স খুব কম ছিল। ২৩ জনের সমাধিতে যতটুকু দেহাবশেষের আলামত মিলেছে আশা করি, জাপানে নিয়ে গিয়ে ফরেনসিক টিম পরীক্ষাগারে ইতিবাচক ফল পাবে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পর অর্থাৎ পঞ্চাশের দশক থেকেই ওই যুদ্ধের সময় বিশ্বজুড়ে নিখোঁজ জাপানি সৈন্যদের খুঁজে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠতে থাকে। তখন প্রায় চব্বিশ লাখ জাপানি সেনা যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল এবং এর অর্ধেকই আর ফিরে যায়নি। যুদ্ধে জাপানের পরাজয় হলেও পঞ্চাশের দশকে বিশ্বজুড়ে সমাধিস্থ হওয়া সৈনিকদের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠতে থাকে।

Manual8 Ad Code

 

বিশেষ করে কনজারভেটিভ পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল কয়েক দশক ধরেই এ দাবিটিকে উপজীব্য করে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে আসছিল এবং পরে এটি বেশ জনপ্রিয় দাবি হয়ে উঠলে দৃষ্টি দেয় জাপান সরকার। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে এসে জাপান পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয় যার লক্ষ্য হলো ২০২৪ সালের মধ্যে জাপানের বাইরে থাকা জাপানি সৈন্যদের দেহাবশেষ উদ্ধার ও জাপানে ফিরিয়ে নেয়া।

 

তবে এর আগে যেসব পরিবারের সেনারা নিখোঁজ ছিল তাদের অনুরোধে ডিএনএ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় জাপান সরকার। ২০২৩ সালের জুলাইতে জাপান হারানো সৈন্যদের দেহাবশেষ বিষয়ক সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র চালু করে, যারা ডিএনএ পরীক্ষার দায়িত্ব পায়।

 

এর আগে ১৯৪৩ সালে প্যাসিফিক অঞ্চলে মারাত্মক বিপর্যয়ের পর সামরিক বাহিনী নিহতদের পরিবারে শুধু পাথর ভর্তি বাক্স পাঠিয়েছিল। যার অর্থ, তাদের পরিবারের সদস্য সৈনিক মারা গেছে। তখন আর কোনও তথ্য পরিবারগুলোকে দেওয়া হয়নি। পরে ১৯৫২ সালে জাপান একটি দল পাঠালেও এশীয় দেশগুলো তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ এসব দেশ জাপানি আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল।

 

Manual3 Ad Code

তারপরেও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার সেনার দেহাবশেষ ফেরত নেয়া হয়েছিল বিভিন্ন দেশ থেকে। এরপর ওই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে আবারও আহত ও নিহতদের পরিবারের দাবির মুখে চালু করা হয়। সরকারি এই মিশন শেষ পর্যন্ত ৩ লাখ ৪০ হাজার দেহাবশেষ উদ্ধার করে যা টোকিওর চিদরিগাফুছি ন্যাশনাল সিমেট্রি অফ আননোন সোলজারস-এ রাখা হয়েছে। তাদের কখনো ডিএনএ টেস্ট হয়নি বা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

 

Manual6 Ad Code

কিন্তু এখন যাদের দেহাবশেষ নেয়া হচ্ছে সেগুলো জাপানে নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের সাথে ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে এবং এরপর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

 

লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, জাপান কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে ময়নামতি সিমেট্রি থেকে জাপানিদের দেহাবশেষ উত্তোলনের জন্য তার সাথে যোগাযোগ করে। এরপর আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু পরে হলি আর্টিজানের ঘটনায় জাপানি অনেকে নিহত হলে এ উদ্যোগ থেমে যায়। এরপর গত বছর তারা আবার যোগাযোগ করে। শেষ পর্যন্ত ১৩ নভেম্বর সমাধি খনন শুরু করে দেহাবশেষ উত্তোলনের কাজ শুক্রবার আমরা শেষ করেছি।

বিশ্বজুড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের জন্য সমাধিক্ষেত্র প্রস্তুত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন।

 

এর বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার হিল্লোল সাত্তার বলেন, জাপানে এ নিয়ে একটা মুভমেন্ট হচ্ছে ত্রিশ বছর ধরে যে কেন আমাদের সৈন্যরা বাইরে পড়ে থাকবে। তারা ভারত থেকে নিয়েছে এরই মধ্যে। লাওসসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকেও নিয়ে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশ থেকে উত্তোলন করা দেহাবশেষগুলো জাপানে ফিরিয়ে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দিবে জাপান সরকার। জাপানে নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করে পরের প্রজন্মের সাথে মিলিয়ে পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তাদের যথাযথ মর্যাদায় সামরিক কায়দায় সেখানে আবার সমাহিত করা হবে।

 

কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দুরে বুড়িচং উপজেলায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত এই ওয়ার সিমেট্রি বা যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র। সরকারি তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে, এটি একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫ হাজার সৈনিক নিহত হন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে তখনকার বার্মা, ভারতের আসাম ও বাংলাদেশে মোট নয়টি যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল।

 

বাংলাদেশে এ ধরনের দুটি সমাধিক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল যার একটি ময়নামতি, আরেকটি চট্টগ্রামে। এর মধ্যে ময়নামতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত তখনকার ভারতীয় ও বৃটিশ সৈন্যদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এই সমাধিক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন।

 

এই সমাধিক্ষেত্রে মোট ৭৩৬টি কবর আছে বলে জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৫৭ জন যুক্তরাজ্যের। এছাড়া তখনকার ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে এলাকা সেই অবিভক্ত ভারতের ১৭৮ ও জাপানের ২৪ জনের সমাধিস্থল এটি।

 

এর বাইরে যাদের সমাধি আছে তাদের মধ্যে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন করে, নিউজিল্যান্ডের চার জন, রোডেশিয়ার( বর্তমানে জিম্বাবুয়ে) তিন জন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ এবং তৎকালীন বার্মা, দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলজিয়াম ও পোল্যান্ডের আছেন একজন করে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code