প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

কমেছে আয়, বাধ্য হয়ে সাশ্রয়ী হচ্ছে মানুষ

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ১৭, ২০২৪, ০৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ
কমেছে আয়, বাধ্য হয়ে সাশ্রয়ী হচ্ছে মানুষ

Manual8 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

ঢাকার রামপুরার জামতলা এলাকায় ছোট্ট একটি চায়ের দোকান চালান খাদিজা আক্তার। পাশাপাশি দোকানে কিছু মুদিপণ্যও বেচেন। সে টাকা দিয়েই চলে পাঁচ সদস্যের সংসার। তার ভাষ্য, আগে এ দোকানের টাকা দিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চালাতে পারলেও গত কয়েক মাস তার আয় বেশ কমেছে।

Manual4 Ad Code

খাদিজা আক্তার বলেন, ‘মানুষের হাতে টাকা নেই, আগের মতো চা খাচ্ছে না। অপ্রয়োজনীয় খরচ করছে না কেউ। এ মোড়ে আগের মতো আড্ডাও নেই।’

 

জুন-জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনে টালমাটাল ছিল দেশের অর্থনীতি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় দুই মাসেও সেই অর্থনীতিতে গতি ফেরেনি। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপ রয়ে গেছে আগের মতোই। নতুন কর্মসংস্থান নেই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কাজ হারিয়েছেন অনেকে। এখনো বিপুল সংখ্যক মানুষের আয়-ব্যয়ে সঙ্গতি নেই। ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে। জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় দ্বিমুখী চাপে চিঁড়েচ্যাপটা অবস্থা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের। তারা জীবনযাপনের খরচ মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে।

বেশ আগে থেকে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে, তখন সরকার যতটুকু বলেছে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি ছিল। এখনো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।-অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা

খাদিজা আক্তার বলেন, ‘চার-পাঁচ মাস ধরে এ অবস্থা। আগে মাসের শেষে সংসার খরচের জন্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বা কখনো কখনো আরও বেশি নিতে পারতাম। কিন্তু এখন ধারদেনা করতে হচ্ছে প্রতি মাসে। এ মাসে পাঁচ হাজার টাকা সমিতি থেকে লোন করেছি।’

 

খাদিজার সুরেই ফার্মগেটের ফল বিক্রেতা মজিবুর রহমান বলেন, ‘দেশে অসুখ-বিসুখের সময় যাচ্ছে। তাও ফল বিক্রি নেই। আগে দিনে আট-দশ হাজার বিক্রি হতো, এখন তিন-চার হাজারও হয় না। অনুষ্ঠান নেই, মানুষের ঘোরাঘুরি নেই, ক্রেতাও নেই।’

একটি কোম্পানির জ্যেষ্ঠ বিক্রয় প্রতিনিধি ফয়সাল জাহিদও জানান তার আয় কমেছে, তিনি সব ক্ষেত্রে সাশ্রয়ের চেষ্টা করছেন। রাজধানীর মধুবাগ এলাকায় চারজনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম তিনি। মাসিক আয় ৪৫ হাজার টাকার মতো। বাসাভাড়া-খাওয়াসহ দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচও চালাতে হয় এই আয়ের মধ্যে। খরচের চাপে নাকাল তিনি।

তিনি জানান, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে তার কোম্পানির পণ্য বিক্রি কমেছে। যে কারণে কমিশন বন্ধ তিনমাস ধরে।

 

ফয়সাল বলেন, ‘কয়েক মাস আগেও প্রতি সপ্তাহে মাংস খেতাম। এখন মাসে একবার মাংস কিনছি। গত বছর এই সময়ে কয়েক দফা ইলিশ কিনেছিলাম, এবার একবার কিনেছি। তিনমাসে বাচ্চাদের নিয়ে কোনো ঘোরাঘুরি হয়নি, ওদের কেনাকাটাও বন্ধ। দুধ, হরলিক্স, নাশতায় কাটছাঁট করছি। গ্রামে মা-বাবাকেও টাকা পাঠাইনি। এখন আয় কমেছে, কিন্তু ব্যয় কমানো অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

 

মানুষ কম ব্যয় করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া তথ্যেও। নিত্যপণ্যের বাজারে বড় একটি কোম্পানি সিটি গ্রুপ। এ গ্রুপের প্রায় তিন ডজন শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো শতাধিক পণ্য বাজারজাত করছে। কোম্পানিটির পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি উন্নতির দিকে গেলেও ব্যবসায়িক পরিস্থিতি ততটা ভালো হয়নি। বেশ কিছু সময় ধরে আন্দোলনের পর দেশে বড় বন্যা হলো। সব মিলিয়ে পণ্যের বিক্রি ও চাহিদা কমেছে।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণ ক্রেতারা পণ্য একদম কম কিনছেন না। যার যতটুকু দরকার তার চেয়েও কম কিনে চালিয়ে নিচ্ছেন। এসব কারণে সার্বিকভাবে কোম্পানিগুলোর পণ্য বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে।’

 

 

বড় চাপ মূল্যস্ফীতির

 

Manual2 Ad Code

গত এক যুগের মধ্যে শেষ অর্থবছরে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপ ছিল মূল্যস্ফীতির। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সে চাপটা এখনো অব্যাহত। এজন্য নতুন সরকার কিছু উদ্যোগ নিলেও সেটার সুফল সাধারণ মানুষ পায়নি।

সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপর থাকলেও তা আগস্ট মাসের তুলনায় কমেছে। সেপ্টেম্বর মাসে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ।

ক্ষমতার এ পালাবদলে শিল্পে নৈরাজ্য, অস্থিরতা আর উৎপাদনের স্থবিরতার মধ্যে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে বলে মনে করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি।

 

‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক, সেপ্টেম্বর ২০২৪’ এর প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, মূল্যস্ফীতি ধারণার চেয়েও বেশি বাড়বে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ১ শতাংশ হবে। এই পূর্বাভাস গত এপ্রিলে দেওয়া পূর্বাভাসের চেয়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, ২০২৩ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০২২ সালের আগস্টে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

এ মূল্যস্ফীতি কমানোই এখন অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে হবে। কীভাবে নিত্যপণ্যের দাম কমানো যাবে, সেদিকেই নজর দিতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা।

 

তিনি বলেন, ‘বেশ আগে থেকে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে, তখন সরকার যতটুকু বলেছে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি ছিল। এখনো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।’

অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা বলেন, ‘এ সুযোগে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে সিন্ডিকেট, যা অনেক দিন ধরেই দেশে চলছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও সাধারণ মানুষ বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারছে না। নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা খুব বিপদে রয়েছে। তারা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।’

 

 

আয় কমেছে অনেকের

 

আগস্টে ক্ষমতার এ পালাবদলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হামলা-মামলা, বেশকিছু শিল্পে নৈরাজ্য, অস্থিরতা আর উৎপাদনের স্থবিরতাসহ নানান কারণে একটি বড় অংশের মানুষের আয় কমেছে। বিশেষ করে আতঙ্কে আছেন হাজারো কর্মী। কাজ হারানোর শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের। তারা এখন খরচ কমিয়েছেন।

এছাড়া সরকার ও রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগীদের একটি অংশেরও এখন আয় নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি দেশের একটি সরকার চলে গেলো, যাদের নানান পরিকল্পনা ছিল, কম-বেশি যা হোক অর্থনীতি একটা গতিতে ছিল। সেটা এখন বন্ধ। এখন নতুন করে সব হচ্ছে, কোম্পানিগুলোর নতুন চুক্তি, নতুন সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়ন- সেটার জন্যও একটু সময় লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘মানুষজনও এখন কিছুটা বিশৃঙ্খল রয়েছে, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সব জায়গায়। তারাও একটু গুছিয়ে নিচ্ছে, খরচ দেখেশুনে করছে। যতটুকু না হলে নয়।’

মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘এছাড়া বিগত সরকারের সময় অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা ছিল। ব্যাংক, গার্মেন্টস, আমদানি-রপ্তানিতে স্থবিরতা ছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সেগুলো স্বাভাবিক হতে আরও দু-চারমাস সময় লাগবে।’

 

 

কেনাকাটা নিয়ে যা বলছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা

Manual3 Ad Code

 

Manual4 Ad Code

বর্তমানে কেনাবেচা নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে। তারা বলেন, আগে ক্রেতারা যে পরিমাণে পণ্য কিনতো, এখন তার চেয়ে কম কিনছে।

উদাহরণ দিয়ে আবু হোসেন নামে একজন বিক্রেতা বলেন, ‘যে ক্রেতা আগে এক কেজি দুধের প্যাকেট কিনতেন, তিনি এখন ২০০/৪০০ গ্রাম নিচ্ছেন। আবার ধরুন আগে মেঝে পরিষ্কারের জন্য ফ্লোর ক্লিনার কিনতো, এখন ডিটারজেন্ট দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। অনেকে দুধ চা, হরলিক্স এমন অনেক খাবার কমিয়েছে।’

রামপুরা ভাই ভাই স্টোরের জামাল হোসেন বলেন, ‘আগে অনেক মানুষ উল্টাপাল্টা কামাইছে, বেশি বেশি খরচ করেছে। এখন তো বড় অংশের সেটা নেই। আগে যাদের দেখতাম ৫-১০ কেজি ছাড়া আলু-পেঁয়াজ কিনতো না, তারা এখন আধা কেজি-এক কেজি নিচ্ছে। এটা এখনকার সময়ের বাস্তবতা।’

 

 

 

অনেকে পরিবার গ্রামে পাঠাচ্ছেন

 

নানাভাবে কাটছাঁট করেও এখন আর খরচ সামলাতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন কয়েকজন। পরিস্থিতি অনেকের জন্য এতটাই খারাপ যে পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে ঢাকায় একা থাকছেন। এমন একজন বাদশা হোসেন ফার্নিচারের দোকান চালান।

তিনি বলেন, ‘সরকারি একটি প্রকল্পে সরবরাহ অর্ডার ছিল, গত মাসে বাতিল হয়েছে। এতে বড় অঙ্কের লোকসান হয়েছে। এছাড়া সাধারণ খুচরা বিক্রি একদম নেই। মানুষ এখন খেতে পারছে না, ফার্নিচার কিনবে কীভাবে? গত মাসে বাসা ছেড়ে দিয়ে পরিবার গ্রামে পাঠিয়েছি।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code