প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৬শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

সাফল্য আর হতাশা মিলিয়ে ১৬ বছর পর কোথায় নেইমারের ‘লিগ্যাসি’

editor
প্রকাশিত এপ্রিল ২৭, ২০২৫, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ
সাফল্য আর হতাশা মিলিয়ে ১৬ বছর পর কোথায় নেইমারের ‘লিগ্যাসি’

Manual4 Ad Code

স্পোর্টস ডেস্ক:
১৬ বছর আগে সান্তোসের হয়ে মোগি মিরিমের বিপক্ষে সাও পাওলো স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে গোল করে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের প্রথম গোলটি করেন নেইমার। দেড় দশক পর, তিনি এখন ব্রাজিল জাতীয় দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা, পেছনে ফেলেছেন পেলে, রোনালদো, রোমারিও এবং জিকোদের মতো কিংবদন্তিদের। গোল করার বাইরেও তিনি অনেক কিছু করেছেন। তবুও, এখনো অনেকের চোখে নেইমার এক ‘অসম্পূর্ণ প্রতিভার প্রতিচ্ছবি’। প্রশ্ন হলো, এটা কি তার প্রতি ন্যায্য আচরণ?

Manual5 Ad Code

নেইমারকে নিয়ে যারা অভিযোগ করেন তাদের যুক্তি শুরু হয় একটি সহজ পর্যবেক্ষণ দিয়ে। যদি ফুটবল শুধু সংখ্যার খেলা হতো, তাহলে সেটা ‘বিংগো’ খেলার মতো হতো।পরিসংখ্যানের জমানো সংখ্যা দিয়ে কখনোই পুরো গল্প বলা যায় না। পেলের ভক্তরা যখন হাজার গোলের রেকর্ডকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তখনই ভুল করেছিলেন। পেলের আসল মেধা ধরা পড়ে বড় ম্যাচগুলোয় যেখানে শিরোপা জয় হয় এবং কিংবদন্তিরা তৈরি হয়।

Manual4 Ad Code

নেইমার এখনো তার ক্যারিয়ার পরিসংখ্যানে উন্নতি আনতে পারেন, কিন্তু তিনিও স্বীকার করবেন যে শিরোপাজয়ের দিক থেকে তিনি পেলের ধারে-কাছেও নেই। পেলের তিনটি বিশ্বকাপ রয়েছে। যদিও মাঝের একটি বিশ্বকাপে তিনি চোটে পড়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেননি, বাকি দুটি বিশ্বকাপে ছিলেন দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। আর নেইমারের অর্জন কী?

Manual6 Ad Code

হ্যাঁ, তিনি ২০১৬ অলিম্পিকে ব্রাজিলকে প্রথম স্বর্ণপদক এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু অলিম্পিক ফুটবলকে মূল শিরোপা হিসেবে ধরা হয় না। তার বাইরে ২০১৩ সালের কনফেডারেশনস কাপ জয় আছে, যেখানে বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনের বিপক্ষে অসাধারণ এক গোল করেছিলেন নেইমার। তবে কনফেডারেশনস কাপের গুরুত্ব বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকার মতো নয়। অভিযোগপক্ষ আরও যুক্তি দেখাবে, নেইমারের ব্রাজিলের হয়ে করা ৭৯ গোলের মধ্যে ৪৬টিই এসেছে প্রীতি ম্যাচে। এর মধ্যে কয়েকটি এমন ম্যাচ ছিল যেখানে ট্রফির লড়াই থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো ছিল প্রীতি ম্যাচের মতোই।

এবার নেইমারের পক্ষে যুক্তি আসবে। এটা তার দোষ নয় যে তিনি এমন সময় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, যখন ২০১৪ বিশ্বকাপের আয়োজক ব্রাজিলের সামনে প্রায় শুধুই প্রীতি ম্যাচ খেলার সুযোগ ছিল। আর প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে তার রেকর্ডও খারাপ নয়, কোপা আমেরিকায় ১২ ম্যাচে ৫ গোল, ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপে ৫ ম্যাচে ৪ গোল, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ২৮ ম্যাচে ১৬ গোল, আর বিশ্বকাপে ১৩ ম্যাচে ৮ গোল।

এ ছাড়া তার বিশ্বকাপ যাত্রা বারবার ব্যাহত হয়েছে চোটের কারণে। ২০১৪ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ভয়ংকর এক ফাউলের শিকার হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। আর ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপেও চোট কাটিয়ে খেলার চেষ্টা করেছেন এবং সেই পরিস্থিতিতে তার পারফরম্যান্স প্রত্যাশিতভাবেই ভালো ছিল।

আরও বলা যায়, যদি ২০২২ সালের কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে শেষ মুহূর্তের গোল না হতো এবং পেনাল্টিতে ব্রাজিল না হারতো, তাহলে নেইমারকে হয়তো জাতীয় নায়ক বানিয়ে ছাড়া হতো কারণ তিনিই দুর্দান্ত একক প্রচেষ্টায় গোল করে ম্যাচের জট খুলেছিলেন। কিন্তু ফুটবলের ইতিহাসে ‘যদি’র কোনো মূল্য নেই। অভিযোগপক্ষ পাল্টা যুক্তি দেবে ইতিহাসে ‘যদি’র কোনো স্থান নেই। আর চোটের জন্য নেইমার নিজেও কিছুটা দায়ী। এই যুক্তি অদ্ভুত শোনালেও, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত, কারণ এটা নেইমারের গল্পের গভীরে নিয়ে যায়।

সাধারণভাবে, যখন কোনো খেলোয়াড় ফাউলের শিকার হযন এবং চোট পান, তখন তাকে দোষারোপ করা হাস্যকর মনে হয়। দোষ তো অপরাধীরই। কিন্তু ফুটবল শারীরিক সংঘর্ষের খেলা। এখানে দীর্ঘদিন ধরেই দেখা গেছে, প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা রুক্ষ আচরণের শিকার হন। তবে আজকের দিনে রেফারিরা খেলোয়াড়দের অনেক বেশি সুরক্ষা দেন। তাই, ফাউল এড়িয়ে চলাও প্রতিভাবান ফুটবলারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। বিশেষ করে যাদের গঠন তুলনামূলকভাবে দুর্বল। পুরনো দিনের স্ট্রিট ফুটবলাররা জানতেন, কখন ড্রিবল করতে হবে আর কখন বল ছেড়ে দিতে হবে।

কিন্তু নেইমার সেই স্কুলের ছাত্র নন। তিনি ফুসবলের পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, যেখানে রেফারির উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে খেলা হয়। অনেক সময় তিনি নিজেই ইচ্ছাকৃতভাবে ফাউল করাতে চাইতেন, রেফারির নজর কেড়ে সুবিধা নিতে চাইতেন। কিন্তু এটা আত্মরক্ষার ভালো উপায় নয়, বরং অনেক সময় তাকে অপ্রয়োজনীয় ফাউল পেতে দেখা গেছে, যা খেলার গতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

মনে করা যায়, নেইমার পেলের যুগে টিকতে পারতেন না। অন্যদিকে, পেলে যদি আজকের যুগে খেলতেন, তাহলে তেমন সমস্যা ছাড়াই মানিয়ে নিতে পারতেন। নেইমার আসলে তার সময়েরই প্রতিনিধি। এক বিশ্বায়িত বিনোদন ব্যবসায় পরিণত হওয়া ফুটবল জগতের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই তার বাবার নেতৃত্বে একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে গড়ে ওঠেন তিনি।

Manual7 Ad Code

অভিযোগপক্ষের যুক্তি হবে, এই প্রকল্পই তাকে কিছুটা নরম বানিয়ে ফেলেছে, প্রতিকূলতার মুখে পড়ে শক্তভাবে লড়ার ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে, নেইমারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ম্যাচ ছিল ২০২০ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল, পিএসজির হয়ে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে। জার্মানরা গোল করার পর দেখা গেল, নেইমারের খেলার ছন্দ একেবারে ভেঙে পড়ে। চাপ তার ওপর স্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলেছিল।

তবে চাপটা অস্বাভাবিকভাবেই বেশি ছিল। পক্ষ সমর্থন করে বলবে, চাপটা সত্যিই অতিরিক্ত ছিল। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নেইমারকে দুইভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছিল, বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিলের গৌরব ফেরানো এবং ব্যালন ডি’অর জেতা। ব্রাজিলিয়ানরা ব্যালন ডি’অরকে তাদের ‘জন্মগত অধিকার’ মনে করতেন। কিন্তু ২০০৭ সালে কাকার পর থেকে আর কোনো ব্রাজিলিয়ান সেই ট্রফি জিততে পারেননি। নেইমারের ওপর সেই বিশাল প্রত্যাশা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল যা কি না দলগত খেলায় অযথাই চাপ তৈরি করেছিল।

এই কারণেই তিনি বার্সেলোনার মতো আদর্শ দল ছেড়ে ২০১৭ সালে পিএসজিতে যোগ দেন। মেসির ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফরাসি লিগের শারীরিক ফুটবল এবং নতুন ক্লাবের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার পরিকল্পনাকে পুরোপুরি সফল হতে দেয়নি। গল্প এখনো শেষ হয়নি এখন উভয় পক্ষই তাদের যুক্তি শেষ করেছে। তবে নেইমারের গল্প এখনো শেষ হয়ে যায়নি। নতুন অধ্যায় এখনো বাকি। ১৫ বছর পার করে তিনি এখন ক্যারিয়ারের শেষভাগের পথে। তবু যদি ফিট থাকেন, তাহলে তার সামনে অন্তত একটি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ রয়েছে।

অনেকেই ভেবেছিলেন পেলে ১৯৭০ বিশ্বকাপে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু মাঠে যোগ্যতা দেখিয়ে তিনি সব সমালোচনার জবাব দিয়েছিলেন। নেইমারও যদি শেষ সময়ে মনোযোগ বাড়াতে পারেন, তাহলে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় অধ্যায় হয়তো এখনো সামনে অপেক্ষা করছে। তবে সে অধ্যায়ের দেখা পেতে হলে ব্রাজিলের এই প্রিন্সকে চোট মোকাবেলা করে আগে নিয়মিত হতে হবে মূল একাদশে। সেটা তিনি পারবেন কি না তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code