প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৬শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

সিলেটের শাহজালাল সার কারখানায় হাজার কোটি টাকার গলদ

editor
প্রকাশিত জুলাই ৯, ২০২৫, ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ
সিলেটের শাহজালাল সার কারখানায় হাজার কোটি টাকার গলদ

Manual1 Ad Code

স্টাফ রিপোর্টার:
প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচে নির্মিত হলেও বছরের পর বছর বন্ধ থেকেছে শাহজালাল সার কারখানা। কখনো গ্যাস নেই, কখনো যন্ত্রপাতির ত্রুটি, আবার কখনো কোনো কারণই জানে না কর্তৃপক্ষ। ব্যয়ের পাহাড় গড়ে তোলা এই ‘মেগাকারখানা’টি বাস্তবে যেন এক ‘মেগাব্যর্থতা’র নাম। এক হাজার দিনের বেশি সময় বন্ধ ছিল এই কারখানার উৎপাদন, অথচ কাগজে সব ঠিক! তদারকি নেই, প্রযুক্তি বাছাইয়ে গাফিলতি, গ্যাস সরবরাহে চরম নির্ভরতা এবং অপরিকল্পিত যন্ত্রপাতির ব্যবহার—সব মিলিয়ে দেশের অন্যতম ব্যয়বহুল প্রকল্পটি এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রের ঘাড়ে।

সম্প্রতি ১০ বছর আগে শেষ হওয়া এই প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়ন করেছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা; যা দফায় দফায় যাচাই করে চূড়ান্ত করেছে আইএমইডি।

Manual3 Ad Code

প্রতিবেদনে দেখা যায়, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল ফার্টিলাইজার কম্পানি লিমিটেড (এসএফসিএল) নামে নির্মিত দেশের সবচেয়ে আধুনিক সার কারখানার জন্য বরাদ্দ হয় প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ, পরামর্শক ও প্রশিক্ষণ মিলিয়ে প্রকল্পটিকে ঘিরে ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, ২০১৫ সালে উদ্বোধনের পর থেকে গত কয়েক বছরে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম এক হাজার সাত দিন বন্ধ ছিল। এর মধ্যে শুধু গ্যাসসংকটে বন্ধ ছিল ৩২০ দিন!

Manual2 Ad Code

এই বন্ধের পেছনে উঠে এসেছে নানা অসংগতি। শুরুতেই দেখা যায়, কারখানার জন্য চীনের প্রযুক্তিনির্ভর গ্যাস টারবাইন সিস্টেম চালু করা হলেও বিসিআইসির কর্মীদের এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। ফলে অপারেটিং সিস্টেমে ঘন ঘন ট্রিপ হয়, যার কারণে পুরো উৎপাদন লাইন থেমে যায়। গ্যাস টারবাইনের বিকল্প হিসেবে স্টিম টারবাইন ব্যবহার করা হলে এমন সমস্যার ঝুঁকি থাকত না, কারণ বিসিআইসির অন্যান্য কারখানার জনবল এ প্রযুক্তিতে দক্ষ।

একই ধরনের ভুল দেখা যায় যন্ত্রাংশ নির্বাচনেও। বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও নির্মাতার মেশিনারি, কন্ট্রোল সিস্টেম ও সফটওয়্যার ব্যবহারে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও জটিলতা বহুগুণ বেড়েছে। একটি যন্ত্র বিকল হলে সেটির জন্য দরপত্র ডাকা, আমদানি অনুমোদন নেওয়া, ডলার সংস্থান করা—সব মিলিয়ে দিন, সপ্তাহ এমনকি মাসও চলে যায়, ফলে কারখানা বন্ধ হয়ে থাকে।

শুধু প্রযুক্তিগত নয়, আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও ছিল চরম দুর্বলতা। যেমন—কারখানার জেটি নির্মাণে ৭৬ কোটি টাকার কার্যাদেশ প্রদান করা হলেও পরে জানা যায়, বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি না থাকায় গ্যাংওয়ে ও পন্টুন নির্মাণ করা যাবে না।

Manual6 Ad Code

সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে প্রায় সাত কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত জেটিটি কার্যকরভাবে ব্যবহার শুরু হয়নি। অর্থাৎ জেটির টাকা মূলত পানিতে গেছে।

এদিকে কারখানার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়েও বড় ধরনের গাফিলতি ধরা পড়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপলাইনে ক্যাথোডিক প্রটেকশন না থাকায় বিভিন্ন জায়গায় লিকেজ দেখা দেয়। এর ফলে একদিকে যেমন পানি অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে কেমিক্যাল মিশ্রণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যাহত হচ্ছে এবং উৎপাদনে ফাউলিং হচ্ছে।

Manual1 Ad Code

একইভাবে বয়লার সিস্টেমেও পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। কারখানার উৎপাদন সচল রাখতে ঘণ্টায় ১৫০ টন স্টিম প্রয়োজন হলেও দুটি বয়লারে মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ছে। তিনটি বয়লার স্থাপন করা হলে এই সমস্যা হতো না। বর্তমানে একটিতে সমস্যা দেখা দিলে পুরো প্লান্ট থেমে যেতে পারে। এমনকি ইউরিয়া তৈরি না হলে পুরো উৎপাদন বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায় প্রতিদিনই।

কারখানার তিনটি ইউনিট, অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া ও ইউটিলিটি ইউনিট তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কন্ট্রোলরুম থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এতে ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়, যা অপারেশন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। অথচ একটি সমন্বিত কন্ট্রোলরুম থাকলে খরচ ও জটিলতা কমত।

যন্ত্রাংশের পাশাপাশি সফটওয়্যারেও আছে বিভ্রান্তি। ডিএসসি, পিএলসি, উডওয়ার্ড কন্ট্রোলার, ডিজিটাল হাইড্রোলিক সিস্টেমসহ একাধিক নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম ব্যবহারে অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স জটিল হয়ে পড়েছে। এগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় একে অন্যের সঙ্গে কাজ করে না, যার ফলে ট্রিপ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

আরো বড় সমস্যা হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায়। কারখানার প্রয়োজন ১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, কিন্তু পাওয়ার প্লান্টের সক্ষমতা সেই তুলনায় সীমিত। দুটি টার্বো জেনারেটর সব সময় চালু রাখতে হয়, যা খরচ বাড়ায়। একটু বেশি খরচ করেও যদি ৮০৩-২৪ ধরনের জেনারেটর স্থাপন করা হতো, তবে একটি রিজার্ভ রাখা যেত এবং দীর্ঘমেয়াদি অপারেশন নিরাপদ হতো।

প্রকল্পটির এই অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘এই প্রকল্পের পর্যবেক্ষণগুলো আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। তারাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code