প্রজন্ম ডেস্ক:
শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থান ছিল সব মত-পথের মানুষের। দেশের সেক্যুলার, ইসলামপন্থি, বামপন্থি, মধ্যপন্থি কিংবা উদার ধারার রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা এক হয়ে লড়েছিল সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটাতে। তবে সরকার পতনের পর বাস্তবতা বদলাতে থাকে। ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে অভ্যুত্থানকারী ফোর্সগুলোর মধ্যকার অনৈক্য ও বিভাজন। এখন মূলত নির্বাচন, সাংবিধানিক সংস্কার, জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার অনৈক্য স্পষ্ট। এখানেই শেষ নয়। অভ্যুত্থানে ভূমিকা পালনকারী ছাত্র নেতৃত্বও পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেছে। এরই মধ্যে সরকারে থাকা জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া দুই ছাত্র প্রতিনিধির বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে।
বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশের দাবি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন। বিপরীত অবস্থানে রয়েছে এনসিপি-জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক দল। সংস্কারের একাংশ বাস্তবায়ন, জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ বেশ কিছু বিষয় নির্বাচনের আগেই নিষ্পত্তি করতে চায় তারা। পরস্পর বিপরীতমুখী এই অবস্থান রাজনীতিতে নানামুখী সংকট সৃষ্টি করছে। বিরাজ করছে উত্তেজনা।
জাতীয় সংসদ, গণপরিষদ, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোনটি আগে হবে তা নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ পুরোনো দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তীব্র। আর তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মূল চাওয়া গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য আগে গণপরিষদ নির্বাচন অথবা একই সঙ্গে গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংস্কার প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে এমন মতবিরোধের মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নও আছে। এর সঙ্গে জুলাই বিপ্লবে কার কী অবদান সেই স্বীকৃতির প্রশ্ন নিয়েও চলছে টানাটানি, কাদা ছোড়াছুড়ি।
আবার সংসদের উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সদস্য মনোনয়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও মতবিরোধ রয়েছে। অন্যদিকে চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ যে খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে তাতে অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকারের বিষয়ে আপত্তি রয়েছে বিএনপির। তা ছাড়া জাতীয় সনদের সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়েও রয়েছে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ।
ঘোষণাপত্র ও সনদের কয়েকটি ক্ষেত্রে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো, জামায়াত, এনসিপিসহ ইসলামি দলগুলো এবং বামদলগুলো আলাদা আলাদা অবস্থান নেওয়ায় ঐকমত্যে পৌঁছাতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না এলে রাজনীতিতে নতুন সংকটের ছায়া দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতা এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। যদি এই সংকটগুলো দ্রুত সমাধান করা না হয় তা হলে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। একটি অর্থবহ সংলাপ এবং রাজনৈতিক সমঝোতাই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ।
রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসানের পর চলে গেছে অনেক সময়। এখন একটি পক্ষ এই অভ্যুত্থানকে সম্পূর্ণরূপে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান হিসেবে দেখছে, যেখানে কোনো একক রাজনৈতিক দলের প্রভাব ছিল না। তারা মনে করে, এর কৃতিত্ব কেবল সাধারণ জনগণ ও শিক্ষার্থীদের। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে যারা এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল বলে দাবি করে, তারা নিজেদের অবদানকে মুখ্য হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এর ফলে বিপ্লবের উদ্দেশ্য ও ফলাফল নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
গত বছর আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকার ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে এবার নতুন তথ্য সামনে এনেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যসহ তিনটি বিষয়ে কথা বলেন গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা নাহিদ।
তিনি বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সম্প্রতি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন জাতীয় সরকারের কোনো প্রস্তাবনা ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাদের দেওয়া হয়নি। তারা অন্য মাধ্যমে এ প্রস্তাবনা পেয়েছিল। নাহিদের দাবি, এই বক্তব্যটি সত্য নয়। তিনি বলেন, আমরা বলেছিলাম অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার করতে চাই। সেই প্রেস ব্রিফিংয়ের পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আমাদের ভার্চুয়াল মিটিং হয়, সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার ও নতুন সংবিধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তারেক রহমান এ প্রস্তাবে সম্মত হননি এবং নাগরিক সমাজের সদস্যদের দিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাজেশন দেন। আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা বলি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে।
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। সনদের কিছু বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে সনদের এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে দলগুলো বলছে, জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে তা বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে। তা না হলে পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। আইনি ভিত্তি না দিলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের।
গতকাল তিনি বলেন, সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে সময় অপচয় করায় সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করবেন। গত ৫৪ বছরের নির্বাচনি পদ্ধতিতে বাংলাদেশে দলীয়করণ, দখল, ভুয়া নির্বাচন, রাতের নির্বাচনসহ নানা অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি এখন সারা বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে যেভাবে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি আছে, বাংলাদেশেও তা প্রয়োজন। জামায়াতের এই নায়েবে আমির বলেন, পিআর পদ্ধতি এখন আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া-প্রতিটি মহাদেশেই আছে। গরিব-ধনী বা কালো-সাদার ভেদে নয়, এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। এমনকি অনেক দেশ প্রতি বছর নতুনভাবে এই পদ্ধতি গ্রহণ করছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদের স্মরণে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক একটা বোঝাপড়া থাকতে হবে। এই বোঝাপড়া না থাকলে এই যে আমরা কাদা ছোড়াছুড়ি করছি, গণতন্ত্রে কাদা ছোড়াছুড়ি হবে, অনেক কথা আসবে কিন্তু এর একটা সীমা থাকা দরকার। তা না হলে একটা তিক্ততা সৃষ্টি হয়, যে তিক্ততা ভবিষ্যতে গিয়ে রাজনীতিকে আরও কলুষিত করে। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস এত সমস্যার পরও ১২টি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য এসেছে, বাকিগুলোতে ঐকমত্যে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, প্রতিদিন বৈঠক হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা ধরে। অনেকগুলো বিষয় আছে যেগুলো আমরা ঠিক বুঝি না সেগুলোও তারা করতে চান।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমি অনুরোধ করব এতটা হতাশ হবেন না, নিরাশ হবেন না। আমরা যদি পারি অতীতে, আমরা যদি সেই ৫২’র ভাষা আন্দোলনে সফল হতে পারি, ১৯৬৯-এ সফল হতে পারি, ৭১-এ সফল হতে পারি, ২৪-এ সফল হতে পারি উইথ অল লিমিটেশন, তা হলে আমরা এটাও পারব। এটা আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি বলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
আগামী কিছু দিনের মধ্যেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, নির্বাচনি কার্যক্রম তো নির্বাচন কমিশন দেখবে। আমি শুধু আমাদের সরকারের নিয়তের কথা আপনাদের বলতে পারি। আমাদের নিয়ত আছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে বেস্ট ইলেকশন দেওয়া, এটা স্যার (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের সবসময় বলেন। তবে জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি কিংবা সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে নির্বাচনে এর কী প্রভাব পড়বে তা অনিশ্চিত।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আগামী চার-পাঁচ দিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য একটি ‘ক্রুসিয়াল’ (খুব গুরুত্বপূর্ণ) সময় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি আশ্বস্ত করেছেন, এই কয়েক দিনে বোঝা যাবে সামনে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত, নির্বাচন দেরি হবে না।
Sharing is caring!