প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১লা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

প্রতিবেশী তিন দেশের সরকার পতনে দুশ্চিন্তায় ভারত

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ
প্রতিবেশী তিন দেশের সরকার পতনে দুশ্চিন্তায় ভারত

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেক্স:

কয়েক বছরের ব্যবধানে দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশের সরকারের পতন ঘটে। ঘটনাগুলো প্রায় একই ধাঁচের। সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ক্ষোভ থেকে বিক্ষোভ এবং ক্ষমতাসীন দলের চরম পরিণতি। সম্প্রতি ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী তৃতীয় দেশ হিসেবে সহিংস আন্দোলনে সরকার পতনের মুখ দেখলো নেপাল।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেছেন। এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সহিংস বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন নিহত হন।

দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে হামলা চালিয়েছে এবং কয়েকজন রাজনীতিবিদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে।

Manual1 Ad Code

অনেকের কাছে কাঠমান্ডুর দৃশ্যগুলো গত বছরের বাংলাদেশ ও ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার অস্থিরতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও ভারতের কাছের প্রতিবেশী, কিন্তু ঐতিহাসিক মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্বের কারণে কাঠমান্ডুর সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

 

নেপালের সঙ্গে ভারতের পাঁচটি রাজ্যের (উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ) এক হাজার ৭৫০ কিলোমিটারেরও (৪৬৬ মাইল) বেশি সীমান্ত অবস্থিত। সীমান্ত পেরিয়ে এ অস্থিরতার দিকে কড়া নজর রাখছে দিল্লি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার সামাজিক মাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মোদী লিখেছেন, নেপালে সহিংসতার ঘটনা হৃদয়বিদারক। বহু তরুণের প্রাণহানি আমাকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছে।

নেপালের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি যে ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- এ কথা জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নেপালের নাগরিকদের শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। মঙ্গলবার মোদী জরুরি নিরাপত্তা বৈঠকে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় বিদ্রোহে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের দেশত্যাগের মতো পরিস্থিতিতে ভারত যেমন অপ্রস্তুত ছিল, নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়েও তারা বিস্মিত হয়েছে। কারণ কে পি শর্মা ওলির সম্প্রতি দিল্লি সফরের কথা ছিল। কিন্তু তার আর দিল্লি সফর করা হলো না বরং এর আগেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।

ভারতের জন্য নেপালের কৌশলগত অবস্থানের কারণে দেশটির যে কোনো অস্থিরতাই উদ্বেগের কারণ।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বিবিসিকে বলেন, চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড নেপালের একেবারে ওপারে। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে পৌঁছানোর পথ সরাসরি নেপাল হয়ে গেছে।

অস্থিরতার প্রভাব রয়েছে ভারতে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক নেপালি জনগোষ্ঠীর ওপরও। অনুমান করা হয়, প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি ভারতে বসবাস বা কাজ করে-যদিও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে।

Manual7 Ad Code

 

নেপাল একটি হিন্দু-অধ্যুষিত দেশ এবং দুই দেশের সীমান্তবর্তী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়াই মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াত করতে পারে। ১৯৫০ সালের চুক্তির আওতায় নেপালিরা অবাধে ভারতে কাজ করতে পারে-এমন সুবিধা শুধু নেপাল ও ভুটানের জন্যই প্রযোজ্য।

এছাড়া নেপালের প্রায় ৩২ হাজার গুর্খা সেনা ভারতের সেনাবাহিনীতে বিশেষ চুক্তির আওতায় কর্মরত।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঙ্গীতা থাপলিয়াল বলেন, যেহেতু সীমান্ত উন্মুক্ত, দুই দেশের মানুষের মধ্যে প্রতিদিনের মতবিনিময়, চলাফেরা ও পারিবারিক যোগাযোগ খুব স্বাভাবিক ঘটনা।

 

Manual5 Ad Code

নেপালে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থস্থান, ট্রান্স-হিমালয় অঞ্চলের মুক্তিনাথ মন্দিরসহ বহু উপাসনালয়। প্রতি বছর হাজার হাজার ভারতীয় তীর্থযাত্রী সেখানে যান।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও নেপাল ভারতের ওপর নির্ভরশীল-বিশেষ করে তেল ও খাদ্য আমদানিতে। দুই দেশের বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার।

বুধবার কাঠমান্ডুতে আপাত শান্তি ফিরলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হবে। কারণ আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলকেই ঘিরে-যারা অতীতে নেপাল শাসন করেছে।

Manual3 Ad Code

 

ওলির নেতৃত্বাধীন সিপিএন (ইউএমএল), শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেস এবং পুষ্পকমল দাহাল (প্রচণ্ড)-এর নেতৃত্বাধীন সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) এই তিন দলের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভারত।

হিমালয় ঘেরা দেশটির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে ভারত ও চীন উভয়েই সেখানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ফলে নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। ওলির পর কোন ধরনের সরকার গঠিত হবে এবং তা আন্দোলনকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।

অধ্যাপক থাপলিয়ালের মতে, ভারত খুব সতর্ক অবস্থান নেবে। তারা নেপালে আরেকটি বাংলাদেশ পরিস্থিতি চায় না।

কারণ দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পর্ক ছিল উষ্ণ, কিন্তু বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন চলছে। ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় দেশটির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের চরম ক্ষোভ এবং অসন্তোষ রয়েছে।

ভারত-নেপাল সম্পর্কেও অতীতে টানাপড়েন ছিল-যা এখন নতুন করে সামলাতে হবে। ২০১৯ সালে ভারত একটি নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে নেপালের দাবিকৃত কিছু এলাকা ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। এতে নেপাল তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং পরে নিজেদের মানচিত্র প্রকাশ করে ওই অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে।

সম্প্রতি ভারত ও চীন নেপালের দাবিকৃত সীমান্ত এলাকার একটি ট্রেড রুট পুনরায় চালু করতে সম্মত হয়েছে। গত মাসে চীন সফরে গিয়ে ওলি এই লিপুলেখ পাসকে বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহারের বিরোধিতা করেছিলেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতকে নতুন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে এবং ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। অধ্যাপক থাপলিয়াল বলেন, নেপালের তরুণদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সীমিত। ভারতকে বৃত্তি, ফেলোশিপ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর কথা গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকায় প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্লেষক মেহতার মতে, ভারত তার বড় শক্তি হওয়ার স্বপ্নে মগ্ন হয়ে আশেপাশের দেশগুলোর দিকে মনোযোগ কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক শক্তি হতে হলে প্রথমেই নিজের আশেপাশে নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code