প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২২শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২রা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

নয়া বাঁকে বিদেশ সম্পর্ক

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ
নয়া বাঁকে বিদেশ সম্পর্ক

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

পাশের দেশ ভারত ও একটু দূরের দেশ চীনের সঙ্গে ১৬ বছরে দুটি ভিন্নমাত্রার ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে শেখ হাসিনার সরকার। ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক পর্যায়ে গড়ে ওঠা এ সম্পর্ক অনেকটা মাখামাখিতে গড়ায়, যেটিকে দেশটির নেতারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে গণ্য করেন। অন্যদিকে, এশিয়ায় ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হয়ে ওঠে প্রধানত অর্থনৈতিক নির্ভরতার। এর বাইরে একমাত্র ব্যতিক্রম পাকিস্তান ছাড়া বৈদেশিক সম্পর্কের অন্য দিকগুলো কমবেশি স্বাভাবিক পথেই চলতে থাকে।

চীনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সম্পর্ক শেষ দিকে খারাপ হতে শুরু করে। তিনি গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করে বছরখানেক আগে দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ শীতল হয়ে যায়। চীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে শুরু থেকেই স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে যত্নবান হয়। আর পাকিস্তান সক্রিয় হয় বাংলাদেশের সঙ্গে অনেকটা সুতোর ওপর টিকে থাকা সম্পর্ক চাঙা করতে। এ কাজে চীনকেও যুক্ত করে দেশটি।

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর পাঁচ মাস পর আগামী ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেবেন বলছেন। ভোটের মাধ্যমে নতুন যে সরকার আসার সম্ভাবনা আছে, তার বিদেশনীতির অগ্রাধিকারগুলো কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে জানার আগ্রহ দেশের কূটনীতিকদের পাশাপাশি বিদেশি কূটনীতিকদেরও।

Manual6 Ad Code

 

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও পাকিস্তানের কয়েকজন কূটনীতিক গত সপ্তাহে বলেন, ১৬ বছর বাংলাদেশ অনেকটা একপেশে বৈদেশিক সম্পর্ক চালিয়ে গেছে। ভোটের পরবর্তী নতুন সরকারের পাশাপাশি সামরিক ও বেসরকারি প্রভাবশালী মহলগুলোর বৈদেশিক সম্পর্কের অগ্রাধিকারে কী পরিবর্তন হতে পারে, তা বুঝতে তারা রাজনৈতিক, সামরিক, বেসামরিক ও বাণিজ্যিক মহলে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলছেন। আনুষ্ঠানিক আলাপ ছাড়াও প্রায় প্রতিদিন হঠাৎ ডাকা অনেক বৈঠক হচ্ছে। কূটনীতিকদের অনেকে মনে করেন, ভোটে জিতে যে দলই নতুন সরকারে আসুক, বৈদেশিক সম্পর্কে ১৬ বছর যে প্রবণতা ছিল, তাতে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে।

Manual4 Ad Code

স্থানীয় কূটনীতিকরা অবশ্য বলছেন, দলগুলো আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যে ইশতেহার দেবে, তা থেকে হয়তো কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আর নির্বাচনের পর নতুন সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হয়, পরর্রাষ্ট্র সচিবসহ বিদেশে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মিশনগুলোয় রাষ্ট্রদূত পদে কী পরিবর্তন আনা হয়, তা থেকেও ইঙ্গিত মিলবে বৈদেশিক সম্পর্ক কোন পথে চলবে।

স্থানীয় কূটনীতিকদের বড় একটি অংশ মনে করেন, সরকারে যেই আসুক, ভূরাজনৈতিক ও বাস্তব কারণে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থল সীমান্ত, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নির্ভরতা এবং নিরাপত্তার দিক থেকে কিছুটা ঝুঁকি থাকার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, দুদেশেরই একে অন্যকে বাদ দিয়ে চলার উপায় নেই।

এদিকে, বিদেশে এখানে-সেখানে সরকারপ্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে সাক্ষাৎ হলেও তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্কে বরফ গলেনি। নিয়মিত কিছু বিষয় ছাড়া নীতিগত সিদ্ধান্তের বড় জায়গাগুলোয় ইউনূসের সরকারকে ভারত এড়িয়ে চলছে। অপেক্ষা করছে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা উদাহরণ হিসেবে বলেন, ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। এ ধরনের চুক্তি নবায়নের আলোচনা শেষ করতেই দুই-আড়াই বছর লেগে যায়। কিন্তু গঙ্গার বিষয়ে আলোচনা এখনো শুরু করা যায়নি।

স্থানীয় কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য মনে করেন, নতুন সরকারের জন্য অপেক্ষা ভারতের দিক থেকে ‘জুতসই’ কৌশল নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সরকার একটি ধারাবাহিকতা। এই বিবেচনায় নতুন সরকারের জন্য অপেক্ষা জুতসই কিছু নেই। শোভনও মনে হয় না। তবে ভারত হয়তো দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের বিবেচনায় আগামী সরকারের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে।’

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল গতকাল আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটবে। দিল্লিতে এক সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে করা এক প্রশ্নে তিনি এ আশাবাদের কথা জানান।

ভারতসহ কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে ‘একটি দেশের জন্য’ দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের অগ্রগতি আছে, নিউ ইয়র্কে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের করা এমন মন্তব্যের বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ভারত আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়াতে চায়। পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, সবাই জানে কোন দেশ সার্কে অগ্রগতি না হওয়ার জন্য দায়ী।

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ১৬ বছর কোনো রকমে টিকে ছিল। শেখ হাসিনার পতনের পরপর দেশটি দ্রুত এ সম্পর্ক ঝালাইয়ে নেমে পড়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বহুপক্ষীয় সফরে যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পাশে ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে শাহবাজ শরিফ বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎমুখী গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। এর আগে দেশটি পররাষ্ট্র সচিব দিয়ে শুরু করে এক বছরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঢাকায় পাঠায়।

Manual2 Ad Code

শুধু তাই নয়, পাকিস্তান চীনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতেও উদ্যোগী হয়। অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য এ ক্ষেত্রে ধীরে চলার কৌশল নিয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করতে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার ওপর ভারতীয়রা নজর রাখছে।

ভারতের চিরবৈরী পাকিস্তান বর্তমানে সৌদি আরবের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি সই ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের হুভার ইনস্টিটিউটের ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিনিয়র ফেলো সুমিত গাঙ্গুলী মনে করেন, আমেরিকা ও সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পর্ক গভীর হলে তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় পড়বে। পররাষ্ট্রবিষয়ক সাময়িকী ফরেন পলিসিতে গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। তিনি অবশ্য সুমিত গাঙ্গুলীর মন্তব্যের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। হুমায়ুন কবির বলেন, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করতে চায় দেশটির সামরিক সক্ষমতার জন্য। ট্যারিফ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে থেকে ভারত কিছুটা বেকায়দায় আছে বলে হয়তো দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব পড়ার কথা আসছে। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক ভারসাম্যের চেয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্যের গুরুত্ব বেশি। কারণ ভারত তার অর্থনৈতিক সামর্থ্য দিয়েই প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

Manual1 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code