প্রজন্ম ডেস্ক:
দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে প্রতিবছর বড় অঙ্কের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবায়নে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির দেখা মেলে না। এই উন্নয়ন যাত্রায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল সংকট এবং বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সঠিক জবাবদিহিতা না থাকায় খেয়ালখুশিমতো প্রকল্প নেওয়া হয়ে থাকে। প্রকল্প প্রণয়নের প্রাথমিক ধাপেই এমন সব দুর্বলতা থেকে যায়, যার ফলশ্রুতিতে সময় ও ব্যয়ের অতিরিক্ত চাপ বাড়ে এবং কার্যত উন্নয়ন থমকে যায়। সঠিক নীতিমালা ও শাস্তির বিধান হলেই কেবল এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। নয়তো এই বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে বছরের পর বছর।
সম্প্রতি এসব বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, দক্ষ প্রকল্প পরিচালক না থাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ছে। প্রকল্প পরিচালকের পদে বাড়তি প্রণোদনা না থাকায় সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তারা দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হন না। ফলে অনেক সময় অভিজ্ঞতাহীন ও অদক্ষ কর্মকর্তাদের ওপরই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের দায়িত্ব এসে পড়ে।
পরিসংখ্যান আরও স্পষ্টভাবে দুর্বল চিত্র তুলে ধরে। গত অর্থবছরে সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৬৭ দশমিক ৮৫ শতাংশÑ যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ আগের পাঁচ অর্থবছরে এ হার ছিল ৮২ থেকে ৯৩ শতাংশের মধ্যে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের দুরবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ বরাদ্দের মাত্র ১৫ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগও ব্যয় করেছে মাত্র ২২ শতাংশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত অর্থের ৪২ শতাংশ ফেরত দিয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলো যেমনÑ ভারত ও ভিয়েতনাম প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। সেখানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, দক্ষ মানবসম্পদ, স্বচ্ছ তদারকি ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকল্প দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়। বাংলাদেশে পরিকল্পনার দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব অনেক প্রকল্পকে শুরু থেকেই ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই ব্যর্থতার পেছনে মূল কারণগুলো চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছেÑ দুর্বল সম্ভাব্যতা যাচাই, সঠিক তথ্যের ঘাটতি, ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তরে বিলম্ব, মৌসুমনির্ভর প্রকল্পের অযৌক্তিক পরিকল্পনা এবং প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) অযথা জটিলতা। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়েই মানসম্মত সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। এজন্য দক্ষ প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা, স্বাধীন পিয়ার রিভিউ বাধ্যতামূলক করা এবং পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কেবল প্রস্তাবনা নয়, বাস্তবায়ন কাঠামোর ভেতরেও রয়েছে নানা ফাঁকফোকর। প্রকল্প পরিচালকের অভাব মোকাবিলায় কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে একটি পিডি পুল গঠন, সার্টিফিকেশন কোর্স চালু, কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পুরস্কার এবং স্পষ্ট নিয়োগ ও বদলি নীতি। পাশাপাশি বিদেশি অর্থায়নকৃত বড় প্রকল্পে লিয়েন বা ডেপুটেশনের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ এবং অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ড. মাহমুদ বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অর্থবছরের শেষ তিন মাসে প্রায় অর্ধেক এডিপি বাস্তবায়নের প্রবণতা ‘অগ্রহণযোগ্য’। তার মতে, অর্থনীতি তো বছরের শুরুতেই থেমে থাকে না। বাজেট প্রস্তুত থাকে, তাই দেরির অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, প্রকল্প প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অনেকেরই অর্থনীতি, বাণিজ্য বা উন্নয়ন পরিকল্পনায় কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ঘন ঘন বদলির কারণে দক্ষ জনবল সরে গিয়ে অভিজ্ঞতাহীনদের হাতে জটিল প্রকল্প চলে যায়। এর ফলে পরিকল্পনা দুর্বল হয় এবং মাঠপর্যায়ে গিয়ে প্রকল্প স্থবির হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তর বারবার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। এজন্য পরিকল্পনা কমিশন আলাদা প্রকল্প নেওয়া, মালিকানা যাচাই, অধিগ্রহণ পরিকল্পনা, অনাপত্তিপত্র ও পরিবেশ ছাড়পত্র অনুমোদনের আগে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দিয়েছে।
পর্যবেক্ষণ ও তদারকি ব্যবস্থাও দুর্বল। বর্তমানে প্রকল্পগুলোর ওপর কার্যকর নজরদারি হয় না। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে আইএমইডি অফিস গঠন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জোরদার করা এবং আইএমইডির গভীর পর্যবেক্ষণ রিপোর্টের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিপি বাস্তবায়নে এমন স্থবিরতার কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা সংকুচিত হচ্ছে। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পর্যায়ে পরিকল্পনা, যোগ্য নেতৃত্ব এবং কঠোর তদারকি নিশ্চিত করা ছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব নয়।
যদি এই ত্রুটিগুলো অবিলম্বে দূর করা না যায়, তবে ‘ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনায় উন্নয়ন স্থবির’ হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা ক্রমেই গভীর হবে। উন্নয়ন প্রণোদিত অর্থ বরাদ্দ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, আর জনগণ কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
Sharing is caring!