প্রজন্ম ডেস্ক:
আওয়ামী নকশায় এবার ‘গুপ্তহত্যা’। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নির্বিচার হত্যার দায়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দলটি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিস্থিতির অবনতি ও সহিংস করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘৃণ্য এই টার্গেট নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে লুটপাট করা বিপুল টাকা। সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে নাশকতার ভয়ংকর সব তথ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও একাধিক গোয়েন্দা সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করছে।
সূত্র জানায়, ছক অনুযায়ী উত্তেজনা তৈরি করতে ইতিমধ্যে ঝটিকা মিছিল, দেশের বাইরে মব তৈরি, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা বৃদ্ধি করেছে নিষিদ্ধ দলটি। সিক্রেট এই মিশন কার্যকর করতে আওয়ামী লীগের পলাতক শীর্ষ নেতারা নিয়মিত হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম গ্রুপে আলোচনা করছে। হত্যার উসকানি দিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন বার্তাও দেওয়া হচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনের আগে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দলটি একটি ‘স্লিপারসেল’ গঠন করেছে। স্লিপারসেল গোপনে গুপ্তচরবৃত্তি, আক্রমণ ও সন্ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে। এর সদস্যরা সমাজে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থাকে। গ্রেফতারকৃত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মোবাইল ও ডিজিটাল ডিভাইস এবং বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপের অ্যাক্টিভিটি যাচাই করা হচ্ছে। সেখানে সন্দেহজনক অনেক তথ্য মিলেছে।
এ ছাড়া অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফোনালাপে হুমকি দেন। তিনি বলেছেন, ‘এক মাঘে শীত যাবে না। গুনে গুনে হিসাব নেওয়া হবে।’ ইউটিউবে পতিত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল কারও পিঠের চামড়া থাকবে না বলে হুমকি দিয়েছেন।’
নওফেল বলেন, বাঙালি অনেক কঠিন। কয়েক দিনের জন্য তারা বসেছে, কারও পিঠের চামড়া থাকবে না। দেশের মানুষকে শেখ হাসিনা ভালোবাসে বলে আওয়ামী লীগ ধৈর্য ধরে অহিংস আন্দোলন করছে। কিন্তু আমাদের নেতাকর্মীরা দেশের স্বার্থ রক্ষায়, গৃহযুদ্ধ এড়াতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের আঞ্চলিক সব শক্তি আছে। বিএনপি-জামায়াত বা জুলাই গোষ্ঠীর সঙ্গে কেউ নেই। তাদের পালাতে হলে, আমাদের আশ্রয় পেতে হবে। তারা কোথাও পালাতে পারবে না। আমাদের নেতাকর্মীরা দেশের ক্ষতি যাতে না হয়, গৃহযুদ্ধ যাতে না হয়, তার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অভ্যুত্থানের পর পরাজিত শক্তি এ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের টার্গেট করে গুপ্তহত্যার মিশনে নেমেছে এমন দাবি শুরু থেকেই করছে জুলাই আন্দোলনে ছাত্র নেতৃত্বদানকারী সংগঠনগুলো। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠনের দাবি অনেক শিক্ষার্থী টার্গেট হামলার শিকার হয়েছেন। নজরদারি ও ফোনে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগও এনেছে সংগঠনগুলো।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এর ব্যাপকতা বাড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাষ্ট্র এই ঘৃণ্য নাশকতার বিরুদ্ধে সব ধরনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে।
গত বছর পরপর কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গত ১২ ডিসেম্বর গাজীপুরে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির তানজীর হোসেন শিহানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন নারায়ণগঞ্জে এআইইউবির শিক্ষার্থী সীমান্তকে ছুরিকাঘাত করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি মারা যান। পরের দিন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পূর্বাচলের ২ নম্বর সেক্টরের লেক থেকে সুজানা আক্তার নামে এক কিশোরীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর সেখান থেকে সাইনুর রশিদ ওরফে কাব্য নামে আরেক কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই দিন চট্টগ্রামে জসিম উদ্দিন নামে একজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। নিহতরা জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ফরিদপুরের সদরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থী কাজী সাইফুল ইসলামের (২৪) ওপর অতর্কিত হামলা হয়েছে। তিনি নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গৃহযুদ্ধের ইঙ্গিত দেওয়া সরাসরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে উসকে দিতে পারে। নিষিদ্ধ থাকা দলটি কোনো অনুশোচনা না করে এ ধরনের সহিংসতা ও অনুশোচনাহীন মনোভাব দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেওয়ার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখছেন তারা। অস্থিরতা ও সহিংস যেকোনো কার্যক্রম মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর হওয়ার পরামর্শ তাদের।
অপরাধ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞের মতে, সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমস্যাগুলো আরও ঘনীভূত হবে। এই সময়ে মব, সহিংস ঘটনাসহ চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, খুন ও ডাকাতি আরও বাড়বে। এ জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে পুলিশকে প্রস্তুত করতে হবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে আরও কঠোর হওয়া জরুরি।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে পুলিশ শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। ফলে জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল। সুতরাং এই দলের নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল করলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার শঙ্কা থাকে। এ জন্য মিছিলে অংশগ্রহণকারী এবং অর্থদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যারা গ্রেফতার হচ্ছে, তাদের কাছে আমরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাচ্ছি। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন বানচাল করা কিংবা আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতি ঘটানোর মতো নাশকতামূলক বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকবে।
Sharing is caring!