প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে গত ১০ সেপ্টেম্বর জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সনদে রাষ্ট্র সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হলেও সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার ইস্যুগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা দূর হয়নি। এ কারণে জুলাই সনদ বাস্তবায়িত হবে কি না, সে নিয়েই এখন দুশ্চিন্তায় রয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। ফলে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হয় সবার নজর এখন সেদিকে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, আগামী ৫ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পুনরায় বৈঠকে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। এবারের বৈঠকের লক্ষ্য, দ্রুত সময়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করা। এ ছাড়া চূড়ান্ত সনদে স্বাক্ষরের তারিখ নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত ঘোষণা, বাস্তবায়ন কমিটি গঠন এবং জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা। এরপর প্রকাশ করা হবে চূড়ান্ত স্বাক্ষরকারীদের তালিকা এবং বাস্তবায়নের রূপরেখা। এসব কাজ শেষ করতে কমিশনের হাতে সময় আছে মাত্র ১৫ দিন। আগামী ১৫ অক্টোবর ঐকমত্য কমিশনের বর্ধিত মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছিল চারটি। এগুলো হলো অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ।
সম্প্রতি ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এসব প্রস্তাব উত্থাপন করা হলেও এখনো এ বিষয়ে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। সংস্কারের সংবিধান-সম্পর্কিত ইস্যুগুলো আগামী সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি। বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি ও গণভোটের মাধ্যমে সনদের বাস্তবায়ন চায় জামায়াতে ইসলামী। আর গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভার দাবিতে এখনো অনড় অবস্থানে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
এমন পরিস্থিতিতে সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত ইস্যুগুলো বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পুনরায় পর্যালোচনা সভা করেছে কমিশন। এরপর গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভার্চুয়াল সভা শেষে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের দুই ধরনের সুপারিশের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমটি হলো সংবিধান আদেশ; গণভোট আয়োজনের জন্য সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত বা উপদেশ গ্রহণ। অপর প্রস্তাবে একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণপরিষদ গঠন, নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা প্রথমেই সংবিধান সংস্কার সভার মাধ্যমে সংবিধান-সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সমাধান করবেন।
ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা অব্যাহত রাখবে তারা। একই সঙ্গে মতভিন্নতা দূর করতে দলগুলোর মতের কাছাকাছি পদ্ধতি এবং সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত ইস্যুগুলো বাস্তবায়নে সরকারের কাছে দুটি সুপারিশ জমা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে কমিশন। কিন্তু তারপরও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত জুলাই সনদে সব দল স্বাক্ষর করবে কি না, তা নিয়ে এখনো সংশয় রয়েছে। কারণ জুলাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য জামায়াতে ইসলামী ছাড়া ২৯টি দল তাদের দুজন করে প্রতিনিধির নাম জমা দিলেও স্বাক্ষরের ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধান্বিত।
এদিকে ঐকমত্য কমিশনের মতামত দেওয়া এবং বৈঠকি আলোচনায় নিয়মিত যোগদানের পরও সনদ বাস্তবায়নসহ বেশ কিছু দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি রাজনৈতিক দল। বাকি ছয়টি দল হলো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। এসব দলের অভিন্ন দাবিগুলো হলো ১. জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। ২. নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে। ৩. সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। ৪. গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান হতে হবে এবং ৫. বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ভারতীয় তাঁবেদার ও ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের বিচার করতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ওপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তথা সরকারের স্বস্তি নির্ভর করছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করে কি না, সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এ পর্যায়ে দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য গড়তে কমিশন, সরকার ও রাজনৈতিক দল সবাই একধরনের চাপে রয়েছে। সরকার ও কমিশনের চিন্তা হলো রাজনৈতিক দলগুলো এতে স্বাক্ষর করে কি না। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা হলো, কোন ইস্যুতে কে কতটকু ছাড় দেবে। কারণ সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা দৃশ্যমান। কেউ চাচ্ছে গণভোট, কেউ সাংবিধানিক আদেশ (সিও), আবার কারও পছন্দ গণপরিষদ সভা গঠন।
ঐকমত্য কমিশনে দুজন প্রতিনিধির নাম জমা দিলেও বিএনপি এখনো স্পষ্টভাবে জানায়নি তারা সনদে স্বাক্ষর করবে কি না। দলটির একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে কমিশনের অনানুষ্ঠানিক আলাপ হয়েছে। জানা গেছে, তারা এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি। অন্যদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সনদে স্বাক্ষরের জন্য জামায়াত কমিশনে কোনো প্রতিনিধির নাম জমা দেয়নি। সূত্র জানিয়েছে, তারা এখনো সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি ও পরিবেশ পর্যালোচনা করছে। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি জানিয়েছে, শর্তসাপেক্ষে স্বাক্ষরের বিষয়টি তারা বিবেচনা করছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখালেও সংস্কারের সংবিধান-সম্পর্কিত ইস্যুগুলো বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে যে মতভিন্নতা তা কাটানোর জন্য কমিশনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে গণভোট, সাংবিধানিক আদেশ ও গণপরিষদ- এই তিন ধরনের পরামর্শ এসেছে রাজনৈতিক ও বিশেষজ্ঞ মহল থেকে।
বিশেষজ্ঞরা কমিশনকে বলেছেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন টেকসই করতে হলে গণভোট বা গণপরিষদের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হবে সবচেয়ে ভালো বিকল্প। তবে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি জুলাই সনদের অংশ হবে না। এর আগে তাদের প্রস্তাবিত দুটি বিকল্প, ‘গণভোট’ এবং ‘সাংবিধানিক আদেশ’- এ পর্যায়ে সমন্বিত করে তারা একটি চূড়ান্ত অভিমত দিয়েছেন। সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত ইস্যুগুলো বাস্তবায়নে এ দুটি সুপারিশ সরকারকে করতে চায় কমিশন।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সনদ বাস্তবায়ন করতে হলে কেবল স্বাক্ষর যথেষ্ট নয়, দরকার বাস্তবিক অগ্রগতি। দলগুলোকে আস্থার জায়গায় আনা, প্রশাসনিক পদক্ষেপের স্বচ্ছতা এবং সময়সীমা নিশ্চিত করাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। এ পর্যায়ে সনদ বাস্তবায়নের পথে কমিশনকে তিনটি বড় বাধা/চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সেগুলো হলো রাজনৈতিক অনাস্থা ও বিভ্রান্তি, সনদ বাস্তবায়নে রোডম্যাপের অস্পষ্টতা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও গ্রহণযোগ্যতা। কাজেই রাজনৈতিক অনাস্থা দূর করতে বিএনপি ও জামায়াতসহ কয়েকটি বিরোধী দল এখনো মনে করছে, সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার বৈধতা আদায়ের চেষ্টা করছে।
সনদের পরবর্তী ধাপ বা বাস্তবায়নের সময়সীমা এখনো পরিষ্কার নয়। ফলে কৌশলগত অস্পষ্টতা দূর করতে এনসিপি ও কিছু ছোট দল মনে করছে, বাস্তবায়ন পদ্ধতি এখনো পরিষ্কার নয়। কোন ধাপে, কে নেতৃত্ব দেবে- এ নিয়ে দ্বিধা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট বড় চ্যালেঞ্জ। জুলাই সনদ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নির্ভর করছে সরকার ও কমিশনের আন্তরিকতার ওপর। শুধু কাগজে-কলমে স্বাক্ষর করলেই হবে না- বাস্তব পদক্ষেপ, সময়সীমা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে। কারণ সমগ্র দেশ ও জাতি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’ তিনি বলেন, এই সনদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। যেমন নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো, সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের রোডম্যাপ এবং নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন ছাড়া সনদ হবে একগুচ্ছ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির দলিল, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকবে না।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন। প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সফরের আগ পর্যন্ত তিনটি আলোচনা হলেও দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হয়নি। কমিশনের আশা, এবারের বৈঠকে আলোচনার মধ্য দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দ্বার উন্মুক্ত হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতদিন ধরে আলোচনায় থাকা এই সনদের লক্ষ্য ছিল একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটানো। কিন্তু বাস্তবায়নের আগে প্রধান প্রধান দল একযোগে স্বাক্ষর না করলে সনদের কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
Sharing is caring!