প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বিয়ানীবাজারে মুক্তিযুদ্ধ: স্তূপীকৃত লাশ মাটিচাপা দিয়ে অভিবাদন জানান জেনারেল ওসমানী

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ
বিয়ানীবাজারে মুক্তিযুদ্ধ: স্তূপীকৃত লাশ মাটিচাপা দিয়ে অভিবাদন জানান জেনারেল ওসমানী

Manual6 Ad Code

 

মিলাদ জয়নুল:

Manual4 Ad Code

 

বিয়ানীবাজার সীমান্তঘেঁষা একটি উপজেলা। ঐতিহাসিক নানকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই এলাকায় যে রাজনৈতিক ধারার সূচনা হয়েছিল, তার প্রতিফলন ঘটে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধেও। উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা যেমন ছিল গর্ব করার মতো, তেমনি দালালদের সংখ্যাও ছিল অনেক।

Manual8 Ad Code

 

লেখক, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার লক্ষে বিয়ানীবাজার উপজেলায় দালালদের ১৭ জনকে নিয়ে হানাদার সৈন্যরা গঠন করে মজলিশে শুরা। পরিকল্পনা মাফিক কুকর্ম সম্পাদন করে পাকিস্তানি হায়েনা এবং তাদের এ দেশীয় বশংবদরা। বিয়ানীবাজার ডাকবাংলোর রান্নাঘরকে তারা পরিণত করে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পেই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন অসংখ্য যুবক, প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ। এর অদূরে টিলাসংলগ্ন একটি কাঁঠালগাছের তলাকে পরিণত করা হয় বধ্যভূমিতে। এই বধ্যভূমিতে প্রাণ দিয়েছেন শতাধিক বঙ্গসন্তান।

 

মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) থেকে আরোও জানা যায়, বিয়ানীবাজার পৌরশহরের ডাকবাংলোর রুদ্ধকক্ষে ইজ্জত দিয়েছেন যেসব জায়া-জননী, তাঁদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। প্রথমে তাদের বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হতো। এতে কেউ রাজি হলে (অস্ত্রের মুখে) নামেমাত্র বিয়েও করত কুক্যাত রাজাকার আবদুল হক কুটুমনা। ধরে আনা ওইসব মা-বোনদের ভোগ করত পাকসেনা ও কুটুমনারা সম্মিলিতভাবে। এভাবে যে কত রমণীর ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে তারা, তার ইয়ত্তা নেই। হাইড়ির লড়াই বিশ্বাসের মেয়ে অঞ্জলি বিশ্বাসকে জোরপূর্বক ধরে এনে বিয়ে করে কুটুমনা। সুপাতলার মহানন্দ ঘোষের বাড়িতেই আটকে রাখা হয় তাঁকে। পর্যায়ক্রমে ভোগ করত সবাই তাঁকে ভাগাভাগি করে। অবশেষে অঞ্জলিকে বিয়ে দেয়া হয় ক্যাপ্টেন গণ্ডলের সাথে। কিছুদিন পর আবার তাঁকে বিয়ে করে কুটুমনা। গোবিন্দ শ্রীর অজয় পুরকায়স্থের ভাগ্নিকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায় চারখাই ক্যাম্পে। ৩-৪ দিন সেখানে আটকে রাখে তারা তাঁকে। মাথিউরা গ্রামের মহেন্দ্র দাশের মেয়ে জ্যোলা এবং নরেন্দ্র দাশের মেয়ে কল্পনাকে ধরে এনে গণ্ডলের দরবারে দু’দিন আটকে রাখা হয়।

 

Manual3 Ad Code

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ লিখেছেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিয়ানীবাজার থানা সদরে আসার পরই বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভস্মীভূত হয়ে যায় খানা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, আয়াজ উদ্দিনের ধান ভাঙার কলসহ অনেকগুলো দোকানপাট। বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালদের সহযোগিতায় নিরীহ-নিরস্ত্র লোকজনকে ধরে এনে খানা সদরের কাঁঠালতলায় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এদের সংখ্যা শতাধিক হলেও সকলের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।

 

বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক আলী আহমদ বেবুল বলেন, বিয়ানীবাজার উপজেলা সদরের কাছেই কসবা গ্রাম। এ গ্রামের বড়বাড়ির আবদুল মান্নান ছিলেন একজন জনপ্রিয় ক্রীড়া সংগঠক। আওয়ামী লীগ করতেন। তাঁর ভাই আবদুল আজিজ ছিলেন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু আবদুল আজিজ তখন ভারতে। একদিন আবদুল মান্নানকে ক্যাপ্টেন গণ্ডলের দরবারে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আবদুল মান্নান ঘৃণাভরে সে নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করলে পাক হায়েনারা চড়াও হয় তাঁর বাড়িতে। পুড়িয়ে দেয় তাঁর বাড়ি। ধরে নিয়ে যায় আবদুল মান্নানের স্ত্রীকে। আটকে রাখা হয় তাঁকে গণ্ডলের ক্যাম্পে। স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষায় উন্মাদ আবদুল মান্নান পরদিন বাধ্য হয়ে হাজির হন গণ্ডলের দরবারে। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কাঁঠালতলার বধ্যভূমিতে। স্বামীর জীবনের বিনিময়ে রক্ষা পায় স্ত্রীর সম্ভ্রম।

 

মুক্তিযুদ্ধকালীন তথ্য থেকে জানা যায়, উপজেলা প্রশাসনের কাঁঠালতলাতেই নিয়ে হত্যা করা হয় বাজার প্রহরী দুলু মিয়াকে। সুপাতলার মিছির আলীকে কর্মরত অবস্থায় একদিন পাকড়াও করে নিয়ে আসা হয়। তাঁকেও হত্যা করা হয় ওই নির্দিষ্ট বধ্যভূমিতে। কসবা গ্রামের আবদুল কাদিরের ছোট্ট একটি শিশুপুত্রকেও হত্যা করেছিল পশুরা নিতান্ত খেলাচ্ছলে। শ্রীধরা গ্রাম থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছিল আফতাব আলীকে।

 

বিয়ানীবাজারের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক খালেদ জাফরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম তার পিতা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হওয়ায় তাদের বাড়িতে আগুণ দিয়ে পুড়িঁয়ে দেয়া হয় সব। শহীদ পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ জাকির হোসেন জানান, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য হওয়ায় সেসময় তার পিতা শহীদ তাহির আলী ও ভাই নিজাম উদ্দিনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানীরা।

Manual5 Ad Code

 

এছাড়াও বন্দিশিবিরে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়েছে অসংখ্য বিয়ানীবাজারবাসীকে। নির্যাতন করা হয়েছে অমানুষিকভাবে
। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন বিয়ানীবাজার উপজেলার অসংখ্য তরুণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে শেষে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে অনেককে।

 

স্বাধীনতার পর শতাধিক লোকের কঙ্কাল কাঁঠালগাছের তলায় স্তূপীকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেগুলো একটি গর্তে মাটিচাপা দিয়ে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানী।

 

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code