প্রজন্ম ডেস্ক:
হত্যার পর পরিচয় গোপন করতে নদীতে মরদেহ ফেলে দেওয়ার সহজ কৌশল বেছে নিচ্ছে খুনিরা। সাম্প্রতিক সময়ে এ কৌশল ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে। নৌপুলিশ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। তবে স্বল্পসংখ্যক নৌপুলিশ দিয়ে বিশাল নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বেশ চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ দ্রুত নৌপুলিশের জনবল বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উদ্ধার করা মৃতদেহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মতে, পানি থেকে উদ্ধার করা মরদেহ পচে গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ফরেনসিক চিকিৎসকরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় অপরাধীরাও থেকে যাচ্ছে অধরা।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নদীতে পাওয়া মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারাই তদন্ত এগিয়ে নেওয়া ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীরা প্রমাণ নষ্ট করতে ও আইনের চোখ ফাঁকি দিতে হত্যার পর মরদেহ ফেলার জন্য নদীকে বেছে নিচ্ছে। এটি তাদের সুপরিকল্পিত অপরাধের অংশ।
পরিসংখ্যান
সম্প্রতি নৌপুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে ৪৩টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যা গত বছর ছিল মাসে গড়ে ৩৭টি।
নৌপুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে ৪৪০টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ হিসাবে প্রতি মাসে মরদেহ উদ্ধার হয় গড়ে প্রায় ৩৭টি। এর মধ্যে ২৯৯টি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হয়। পরিচয় শনাক্ত হওয়া মরদেহের মধ্যে পুরুষ ২৩০ জন, নারী ২৮ জন এবং শিশু ৪১ জন। বাকি ১৪১ জনের মরদেহ শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এর মধ্যে পুরুষ ১০৫ জন, নারী ২২ জন এবং শিশু ১৪ জন। অর্থাৎ উদ্ধার মোট মরদেহের ৩১ শতাংশের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
অন্যদিকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশের নদী থেকে ৩০১ জনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌপুলিশ। এ হিসাবে প্রতি মাসে মরদেহ উদ্ধার হয় গড়ে প্রায় ৪৩টি। এর মধ্যে ২০৯ জনের মরদেহ শনাক্ত করা গেলেও ৯২ জনের পরিচয় জানা যায়নি। তাদের মধ্যে পুরুষ ৬১ জন, নারী ২৪ জন এবং শিশু ৭ জন। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। তাদের ডিএনএ স্যাম্পল বা নমুনা সংরক্ষণ করে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।
অন্যদিকে নৌপুলিশ খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫০টিরও বেশি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টির পরিচয় শনাক্ত হলেও অশনাক্ত রয়ে গেছে ২০টি।
বর্ষাকালে বাংলাদেশের নদীপথের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় প্রায় দ্বিগুণ। স্বল্পসংখ্যক নৌপুলিশ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমেই যেখানে নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব সেখানে বর্ষা মৌসুমে তা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। সেই সঙ্গে আছে পর্যাপ্ত নৌযানসহ আধুনিক সরঞ্জামের অভাবও।
নৌপুলিশ সূত্রে জানা যায়, শুষ্ক মৌসুমে দেশে নদীপথের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার। আর বর্ষাকালে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার। বিশাল এই নদীপথের নিরাপত্তা রক্ষায় নৌপুলিশের সদস্য সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৮০০ জন। ফাঁড়ি আছে ১২২টি। অনুমোদিত ৩৫টি ফাঁড়ি এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে নৌপুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান বলেন, নদীপথের নিরাপত্তা জোরদার করতে প্রয়োজন দশ হাজার সদস্য। এ মুহূর্তেই প্রয়োজন কমপক্ষে পাঁচ হাজার নৌপুলিশ। কিন্তু বর্তমানে আছে মাত্র ১ হাজার ৮০০ নৌপুলিশ। আবার একটি ফাঁড়ি থেকে আরেকটি ফাঁড়ির দূরত্বও অনেক। আছে যানবাহনের স্বল্পতাও। ১৫৭টি ফাঁড়ির অনুমোদন থাকলেও এখন পর্যন্ত ৩৫টি ফাঁড়ি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও স্বল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে বিশাল এ নদীপথের নিরাপত্তা রক্ষায় নৌপুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে নৌপুলিশ সুপার ড. মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, নদ-নদীতে মরদেহ ফেলা অপরাধীদের কাছে নিরাপদ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নৌকা বা ফেরি থেকে পড়ে অথবা গোসল করতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে হত্যার পর মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, স্থলভাগে মরদেহ ফেলার তুলনায় নদীতে ফেললে ভুক্তভোগী ও হত্যাকারীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়। পানিতে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে মরদেহের চেহারা বিকৃত হয়, জলজ প্রাণী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শরীরের টিস্যু নষ্ট হয়ে যায়। এতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা অন্যান্য শনাক্তকরণ পদ্ধতি অকার্যকর হয়ে পড়ে। শুধু ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নির্ণয় সম্ভব হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।
তিনি বলেন, ইদানীং উদ্ধার হওয়া মরদেহের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তদন্তে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার। হত্যার পর মরদেহ লুকানো কঠিন হলেও নদীতে ফেলে দিলে অপরাধীদের ধরা কঠিন হয়ে পড়ে।
আইনের চোখ ফাঁকি দিতেই অপরাধীরা নদীপথকে বেছে নিচ্ছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক এ প্রসঙ্গে বলেন, অপরাধীরা প্রমাণ নষ্ট করতে ও আইনের চোখ ফাঁকি দিতে হত্যার পর মরদেহ ফেলার জন্য নদী ও রেলপথ বেছে নেয়। মূলত সংঘবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটে। অপরাধীরা হত্যার আগেই নির্ধারণ করে নদী এলাকার কোথায় মরদেহ ফেলা হবে।
সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অতিরিক্ত আইজিপি ও নৌপুলিশ প্রধান কুসুম দেওয়ান বলেন, দেশে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতি বছরই নদী থেকে মৃতদেহ উদ্ধারের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে বর্ষাকালে এ সংখ্যা বেশি হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেন বর্ষাকালে বেশি মৃতদেহ পাওয়া যায় এর কারণ উদঘাটনের জন্য স্টাডি হচ্ছে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নদীপথে পাওয়া মরদেহগুলোর মধ্যে যাদের শরীরে বা গলায় ক্ষত চিহ্ন থাকে সেগুলোর ক্ষেত্রে হত্য মামলা করা হয়। আর যাদের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া যায় না সে ক্ষেত্রে পোস্ট মর্টেমের ওপর নির্ভর করতে হয়।
নৌপুলিশপ্রধান আরও বলেন, নদী থেকে মরদেহ উদ্ধার হলে পরিচয় শনাক্ত করাই তদন্ত এগিয়ে নেওয়া ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে মরদেহ পচে যাওয়ায় শনাক্ত করা যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে মরদেহ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ভেসে যায় কিংবা প্রমাণ নষ্ট করতে অপরাধীরা অন্য কোথাও হত্যার পর মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়। প্রতিটি মামলায় পরিচয় শনাক্ত করতে নৌপুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।
গাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা : গত মাসে ঢাকার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর পৃথক স্থান থেকে এক দিনে নারী-শিশুসহ অজ্ঞাতনামা চারজনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌপুলিশ।
চলতি মাসের ১১ তারিখে শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে নিখোঁজের দুদিন পর ১০ বছর বয়সি নাজমুল নামে এক শিশুর মরদেহ নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
মরদেহ উদ্ধারের পর সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বলেন, শিশুটির শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, নাজমুলের মুরগির খামারে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে শিশুটির মৃত্যু হয়। পরে মরদেহ গুম করার উদ্দেশ্যে নদীতে ফেলে দেওয়া হতে পারে।
১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার রামুর বাঁকখালী নদী থেকে এক কিশোরীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি।
Sharing is caring!