প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১লা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

প্রবাসী আয়ের এমন প্রবৃদ্ধি টিকবে তো?

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫, ০৯:১৩ পূর্বাহ্ণ
প্রবাসী আয়ের এমন প্রবৃদ্ধি টিকবে তো?

Manual6 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

সবশেষ অর্থবছরে দেশে যে রেমিটেন্স এসেছে, সেটা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার বেশি।

Manual5 Ad Code

দেশের পট পরিবর্তনের পর অর্থপাচারের ‘হুন্ডি নেটওয়ার্ক প্রায় অচল হয় পড়ার’ কারণেই এমন প্রবৃদ্ধি এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু এমন প্রবৃদ্ধি কতদিন টিকবে; কিংবা ‘হুন্ডি নেটওয়ার্ক’ই বা কত দিন নিষ্ক্রিয় থাকবে, সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।

Manual3 Ad Code

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রশ্নের উত্তর কী হবে, তা নির্ভর করবে নতুন সরকারের ওপর। তারা যদি হুন্ডিতে অর্থপাচারে লাগাম টানা, প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা দুর্নীতি মোকাবেলায় সক্ষমতা দেখাতে না পারে, তাহলে এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

সক্ষমতা বাড়বে কীভাবে, সেই পরামর্শে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্কার চলমান রাখতে হবে; নীতি প্রয়োগে কঠোর মনোভাবও থাকতে হবে।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, জনশক্তি রপ্তানির বর্তমান প্রবাহ অব্যাহত থাকলে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি হয়ত ‘খুব একটা কমবে না’।

তিনি বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকে অর্থপাচারকারীদের ‘হুন্ডি নেটওয়ার্ক কাজ করছে না’। ডলারের দর বেশি হওয়ায় প্রবাসীরাও ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে ‘বেশি উৎসাহ পাচ্ছেন’।

পঞ্জিকা বছর ধরে রেমিটেন্স প্রবাহের হিসাব রাখে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব কষে অর্থবছর ধরে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পাঠান, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।

এর আগে দেশে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে কোভিড মহামারীর সময়; ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে প্রবাসী আয় আসে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।

মহামারী শেষে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে গতি ফিরলে আমদানি বেড়ে গিয়ে বিদেশি মুদ্রার ওপর চাপ বাড়তে থাকে।

আমদানির নামে ওই সময়ে অর্থপাচারও হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা—বিএফআইইউয়ের সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এক সংবাদ সম্মেলনে সেই পাচারের পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছিলেন, প্রকৃত আমদানি মূল্যের চেয়ে ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ’ বেশি দাম দেখানো হয় অর্থপাচার করতে।

তবে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছর ও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রেক্ষাপট ভিন্ন বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘‘মহামারীর সময় কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। জীবন বাঁচাতে হুন্ডি নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। যিনি পাঠাবেন, তিনিও যেতে পারেননি, আবার যিনি হুন্ডিতে সহায়তা করবেন, তিনিও ঘরে ছিলেন। তাই নেটওয়ার্ক কাজ করেনি। ব্যাংকই ছিল একমাত্র ভরসা।

‘‘আর এখনকার বিষয়টি আলাদা। যারা অর্থপাচার করবেন, তারাই তো দেশে আত্মগোপনে, নয়ত জেলে বা গোপনে বিদেশে চলে গেছেন।’’

চলতি অর্থবছর শেষে রেমিটেন্সের হিসাব কেমন দাঁড়াতে পারে, সেই প্রশ্নে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘প্রথম প্রশ্নটি হলো, ৩০ বিলিয়ন ডলার আসবে কিনা। কারণ, এ পরিমাণ রেমিটেন্স তো আসত না। এবার এসেছে ভিন্ন কারণে।

“রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অর্থপাচারের গোষ্ঠী নেই। তাই হুন্ডি নেটওয়ার্ক বন্ধ বলা যায়। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কিছু ভূমিকা রয়েছে।’’

আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের কথা বলে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশনও সেই সময়সীমা ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কারো কারো আশঙ্কা, নির্বাচনের পর হুন্ডি নেটওয়ার্ক ফিরে আসতে পারে।

এক্ষেত্রে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘সংস্কার চলমান রাখতে হবে। কঠোর থাকতে হবে নীতি প্রয়োগে। প্রায়োজনীয় জনবল দেওয়া ও কাঠামোগত বিষয়ে সরকারকে এখন থেকেই জোর দিতে হবে।’’

Manual3 Ad Code

দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে এ উদ্যোগে সম্পৃক্ত করতে পারলে সফলতা বেশি আসবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘‘দুর্নীতি এখন একটা নিজেই সিস্টেম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে একটি গোষ্ঠীতন্ত্র কাজ করে। দুর্নীতি যদি ফিরে আসে, তাহলে অর্থপাচারেরও পথ তৈরি হবে।’’

রেমিটেন্সের প্রবাহ ধরে রাখতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বিদেশে যাওয়ার খরচ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন, ‘‘অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল (হুন্ডি) তো এখন বন্ধ রাজনৈতিক কারণে; রাজনৈতিক সরকার তো নেই।

“হুন্ডি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউসহ অন্যদের কিছুটা ভূমিকাও আছে এখানে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার এলে এই ভূমিকা ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে তো প্রশ্ন থেকেই যায়।”

এ গবেষক মনে করেন, হুন্ডির সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘গোষ্ঠীতন্ত্রকে’ মোকাবেলা করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো এখনই করা সম্ভব। এজন্য নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।

“প্রবাসে যাওয়ার খরচ আরও কমিয়ে আনা সম্ভব। সেই কাজ করতে তো রাজনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন লাগে না।’’

Manual8 Ad Code

প্রবাসে শ্রমিক পাঠানোর কাজে সম্পৃক্ত রিক্রুটিং প্রতিষ্ঠানের খরচ অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সত্যায়নেও গুনতে হয় বাড়তি অর্থ।

এসব খরচ ও বিমান ভাড়া কমিয়ে আনতে পারলে শ্রমিক পাঠানোর খরচ কমে যাবে মন্তব্য করে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘বিদেশে থাকা অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার মত কাজটি কেউ করছে না। সরকার ও দূতাবাসগুলো চাইলে কাজটি করতে পারে; সুযোগও আছে।

“বিশাল সংখ্যক অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ করতে পারলে তারাও ব্যাংকে রেমিটেন্স পাঠাতে পারবেন। তখন রেমিটেন্স প্রবাহ ঠিক থাকবে।’’

হুন্ডি স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে বিভিন্ন দপ্তরে ‘গোষ্ঠীতন্ত্রের’ প্রভাবমুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

 

প্রবাস যাওয়ায় উঠানামা

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সংস্থা জনশক্তি রপ্তানিকারক ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে কাজের জন্য বিদেশ যান ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন।

আগের বছরের তুলনায় তা ২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮৪ জন বা ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম। অন্যদিকে ২০২৪ সালে রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি হয় ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

২০২৩ সালে প্রবাসে যান ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন। সে বছর বিদেশে কর্মসংস্থান ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ কমে যায় । যদিও ২০২৩ সালে রেমিটেন্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয় ৩ শতাংশ।

তারও আগের বছর ২০২২ সালে বিদেশে যান ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন, যা আগের বছরের চেয়ে ৫ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৪ জন বেশি। সে হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয় ৮৪ শতাংশ। তবে ওই বছর রেমিটেন্স ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ কমে যায়।

কোভিড সংক্রমণ কমতে শুরু করলে ২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন ব্যক্তি কর্মসংস্থানের জন্য যায় বিদেশে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৮৩ শতাংশ বেশি। রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

অন্যদিকে ২০২০ সালে কোভিড মহামারীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিদেশ শ্রমিক পাঠানোয় ধস নামে। ওই বছর ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন বিদেশ যায়, যা আগের বছরের চেয়ে ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ কম।

 

পাঁচ বছরে একবার রেমিটেন্স কমেছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে মোট রেমিটেন্স আসে ২ হাজার ২৮৯ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি।

২০২৩ সালে রেমিটেন্স আসে ২ হাজার ১৯৪ কোটি বা ২১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশ।

২০২২ সালে রেমিটেন্স কমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

সে বছর রেমিটেন্স আসে ২২ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে প্রবৃদিধ ছিল ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code