প্রজন্ম ডেস্ক:
খাগড়াছড়িতে চলমান উত্তেজনা ও আঞ্চলিক সংগঠনের অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে সোমবারও (২৯ সেপ্টেম্বর) এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করেছে। খাগড়াছড়িসহ আশপাশের এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল আতঙ্ক। অপর দিকে আহত পাহাড়িদের উন্নত চিকিৎসা ও নিহতদের লাশ সৎকারের কথা বিবেচনা করে গতকাল দুপুর থেকে খাগড়াছড়ি-ঢাকা এবং খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কে অবরোধ শিথিলের ঘোষণা দেয় ইউপিডিএফের ছাত্রসংগঠন ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’। তবে জেলার অন্য অভ্যন্তরীণ সড়কসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর দুই জেলা রাঙামাটি এবং বান্দরবানে অবরোধ কর্মসূচি বলবৎ থাকবে বলে তাদের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানানো হয়।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে উসকানি ও গুজব ছড়িয়েই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। স্থানীয় মারমা সম্প্রদায়ের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর আঞ্চলিক সংগঠনের উসকানি ও গুজবের প্রভাবে হয় পাহাড়ি-বাঙালির দাঙ্গা বা সংঘাত। তবে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও নতুন করে সহিংসতা এড়াতে বর্তমানে সতর্কাবস্থায় খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু অবরোধের কারণে ওই অঞ্চলে চলাচলকারীরা পড়েছেন মারাত্মক ভোগান্তিতে। পাশাপাশি খাগড়াছড়িতে বহাল রয়েছে প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা। কয়েক দিনের তাণ্ডব ও রবিবারের ভয়ানক সহিংসতার পর অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়েছে পার্বত্য অঞ্চলের শারদীয় দুর্গোৎসব।
গতকাল জেলাসদরসহ বিভিন্ন উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ ও ব্যাটালিয়ন পুলিশ টহল দিয়েছে। কাউকে সন্দেহ হলেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে গতকাল রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জেলার কোথাও কোনো ধরনের সংঘাত-সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় সূত্রগুলো গতকাল জানিয়েছে, যেদিন থেকে ঘটনার সূত্রপাত্র হয়েছে সেদিন থেকেই আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল) এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ সুপরিকল্পিতভাবে সাধারণ পাহাড়ি বাসিন্দাদের মাঝে উসকানি ও গুজব ছড়িয়ে দেয়।
গত রবিবার রাতে এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনীও বলেছে, বিগত কয়েক দিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট যে, ইউপিডিএফ এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার নারী এবং কোমলমতি শিশুদের দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে। একইসঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানোর লক্ষ্যে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) স ম মাহবুব-উল-আলম বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে- পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস। দীর্ঘদিন ধরে সুপরিকল্পিতভাবে এই দুটি বিষয়ে নানা রকম উসকানিসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সুবিধাভোগী অল্পকিছু পাহাড়ি মানুষ। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পক্ষের তৎপরতাও রয়েছে। ফলে পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ের মধ্যে সম্প্রীতি, বিশ্বাস বা আস্থা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে যেসব সমস্যা বড় বড় সংকট সৃষ্টি করছে সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে কিছুদিন পর পর এ ধরনের উত্তেজনা ও সহিংসতা ঘটতেই থাকবে।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) স ম মাহবুব-উল-আলম আরও বলেন, খাগড়াছড়ির এবারের সহিংসতা বড় আকার ধারণ করার পেছনে রাজনৈতিক সংকট লক্ষ্য করা গেছে। কারণ পার্বত্য অঞ্চলে বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলের সেভাবে সাংগঠনিক তৎপরতা বা জোরালো ভূমিকা রাখার মতো অবস্থান নেই। রাজনৈতিক নেতাদের সে রকম অবস্থান থাকলে তারা নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে সংকটের সমাধানের চেষ্টা চালাতেন।
অবরোধে সীমাহীন ভোগান্তি
চলমান অবরোধ কর্মসূচির কারণে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। যদিও সহিংস ঘটনার প্রেক্ষাপটে পর্যটক অনেকাংশেই কমে গেছে। তার মাঝেও গতকাল ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী নৈশকোচগুলো নিরাপত্তাবেষ্টনীতে গতকাল সকালে খাগড়াছড়ি পৌঁছায়। এ ছাড়া খাগড়াছড়িতে আটকা পড়া পর্যটকদের নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। তবে অভ্যন্তরীণ সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা যথেষ্ট ভোগান্তির শিকার হন। জেলা শহরের ভেতরে সীমিতসংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশা চললেও দিনমজুর ও পরিবহন শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এতে তাদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ ও অসন্তোষ। এ ছাড়া জেলার প্রায় সব কটি হাট-বাজার বন্ধ থাকায় খাবারসংকটে পড়তে হয়েছে পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীকে।
এদিকে অবরোধের কারণে কয়েক দিন ধরে জেলা সদরে আটকা পড়েছে বেশ কিছু পণ্যবোঝাই ট্রাক। এতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাকসবজি ও কৃষিপণ্য নিয়ে বিপাকে পড়েন ব্যবসায়ীরা। ট্রাকে নষ্ট হচ্ছে ডিমসহ কোটি কোটি টাকার পচনশীল পণ্য।
খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা বহাল
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার গতকাল বলেন, ‘অবরোধ চলাকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এবং জনগণের জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকায় গত শনিবার দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত খাগড়াছড়ি জেলা সদর এবং গুইমারা উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু ১৪৪ ধারা চলাকালীন পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি, জনমনে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও শঙ্কা কাটেনি। তাই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বহাল থাকবে।’
সহিংসতায় শারদীয় দুর্গোৎসব ম্লান
মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে গত রবিবার থেকে সারা দেশে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হলেও সাম্প্রতিক সহিংসতায় খাগড়াছড়িতে উৎসব আমেজের ছিটেফোঁটাও নেই। জেলার ৬৫টি মণ্ডপ এখনো খাঁখাঁ বিরানভূমি। মন্দিরগুলোতে নেই পুণ্যার্থীদের ভিড়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় এই উৎসবের মাঝে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি দেওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা।
এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি সনাতন সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি নির্মল দেব বলেন, ‘আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অমানবিক আচরণে আমরা খুবই মর্মাহত। সনাতনীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের সময় সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়ায় আমরা নির্বাক। দুর্গাপূজা একটি সর্বজনীন উৎসব। কিন্তু জুম্ম ছাত্র-জনতার সড়ক অবরোধের কারণে কেউ এবার উৎসব পালন করতে পারছেন না।’
প্রসঙ্গত, গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের সিঙ্গিনালা এলাকায় এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ ও ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র উসকানিতে উত্তপ্ত হয় খাগড়াছড়ি জেলা। পরে দফায় দফায় সড়ক অবরোধের ঘোষণা দেয় ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’। অবরোধকে ঘিরে পাহাড়ি-বাঙালি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ত্রিমুখী সংঘর্ষে ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সব শেষে গত রবিবার খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় তিনজন পাহাড়ি বাসিন্দা নিহত এবং তিনজন অফিসারসহ ১৩ জন সেনাসদস্য, পুলিশ ও সাংবাদিকসহ আহত হন অর্ধশতাধিক।
সহিংসতায় আসকের উদ্বেগ, দায়ীদের চিহ্নিত করার দাবি
খাগড়াছড়িতে সহিংসতায় তিনজনের মৃত্যু, সেনাসদস্যসহ বেশ কয়েকজন আহত এবং সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সেখানে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানিয়েছে আসক।
গতকাল আসকের সিনিয়র সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। আসকের বিবৃতিতে বলা হয়, ওই ঘটনায় অবিলম্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর ন্যায়বিচার, নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।
বিবৃতিতে আসক আরও বলেছে, ‘পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কেবল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য নয়; বরং জাতীয় ঐক্য ও দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সহিংসতা, ভীতি ও উসকানি কখনোই সমাধান নয়। এগুলো কেবল পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। আসক মনে করে, নাগরিক অধিকার সবার জন্য সমান। কারও প্রতি অবিচার, কারও প্রতি বৈষম্য কিংবা কারও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়া মানে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।’
Sharing is caring!