প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২২শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২রা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

শিক্ষকদের অবসরে, স্বস্তির বদলে কান্না

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ১, ২০২৫, ০৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ
শিক্ষকদের অবসরে, স্বস্তির বদলে কান্না

Manual6 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual5 Ad Code

 

অবসর জীবনে শিক্ষকদের থাকার কথা স্বস্তিতে। কারণ অবসরের পর প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তারা বাকি জীবন শান্তিতে থাকবেন। কিন্তু এসব সুবিধা ঘরে আনার হয়রানিতে স্বস্তি যেন অধরা হয়ে পড়েছে। স্বস্তির বদলে কান্নাই এখন নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Manual6 Ad Code

চাকরিজীবনে তুলনামূলক কম সুযোগ-সুবিধা পান বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। তাই সবার আশা থাকে অবসর ভাতায় বাকি জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাবেন। কিন্তু সে রকমটা হচ্ছে না। তহবিল-সংকটে আটকে আছে অবসরে যাওয়া প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ভাতা। যার নিষ্পত্তিতে লাগবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেন্ডিং আবেদন নিষ্পত্তিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় শিক্ষকদের দুঃখ লাঘব করতে পারছেন না।

Manual4 Ad Code

এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরকালীন ভাতা দেওয়া হয় একটি বোর্ড থেকে; যার নাম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড। রাজধানীর পলাশীতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় অবস্থিত। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষকরা তাদের আবেদনের খোঁজখবর নিতে আসছেন সেখানে। উদ্বিগ্ন মনে কক্ষের ধারে ধারে ঘুরছেন ফাইল নিয়ে। বেশির ভাগ সময় হতাশা নিয়ে তাদের অভ্যর্থনা ডেস্কের সামনে অপেক্ষা করতে হয়।

সেখানে গত ১ সেপ্টেম্বর দুপুরের পর কথা হয় একটি আলিম মাদ্রাসা থেকে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মফিজুর রহমানের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি এসেছেন নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলা থেকে। বিষণ্ন মনে চেয়ারে বসেছিলেন এক প্রান্তে। কাছে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করতেই তার কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরল অনবরত। ২০২২ সালে আবেদন করেছিলেন অবসর ভাতার জন্য। এখনো টাকা পাননি। কবে পাবেন তাও অনিশ্চিত। মাসে ৪০ টাকা বেতনে ৩৯ বছর আগে মাদ্রাসায় চাকরি শুরু করেন। যখন অবসরে যান, তখন বেতন হয় ৪৫ হাজার টাকা।

আলাপের একপর্যায়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘চাকরি শেষ হলে কোনো পেনশন নেই। খালি হাত নিয়ে বাড়ি যেতে হয়। ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ১০ টাকা দিলে বাজারে গিয়ে হয়তো একটু চা খাওয়া যায়। অন্যথায় বাড়িতে বসে থাকতে হয়। নিয়ম হওয়া দরকার ছিল, শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার অন্তত এক মাসের মধ্যে যেন টাকাটা পায়। তাহলে আমরা সম্মান নিয়ে থাকতে পারি।’

কথা যতই বাড়ল, ততই হতাশা, ক্ষোভ, আক্ষেপ প্রকাশ পাচ্ছিল এ শিক্ষকের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘আবেদন করার পর তিন বছর পার হয়ে গেছে। খোঁজ নিতে আসতেই কত কষ্ট! কঠিন কষ্ট। ৮ ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়। শিক্ষকদের বেতন, মর্যাদা সবই কম। অথচ বলা হয় শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু মেরুদণ্ডের কোনো শক্তি নেই। লেখালেখি করেন, শিক্ষকদের কষ্ট যেন কমে। আমাদের না হলেও ভবিষ্যৎ জেনারেশনের কাজে লাগবে।’

শুধু এই শিক্ষক নন, এমন অবস্থা হাজারও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের। অর্থকষ্টে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন তারা। অবসর ভাতার আবেদনের খোঁজ নিতে এসে অনেকে অবসর সুবিধা বোর্ডের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে না পেরে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলছেন। পরিচালক তাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরছেন। সরকারের কাছ থেকে ফান্ড পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা তাদের জানাচ্ছেন। অনেকে পরিচয় দিয়ে টাকা পাওয়ার জন্য অনুরোধও করছেন। পরিচালকের স্পষ্ট উত্তর, আবেদনের সিরিয়াল অনুসারে ফান্ড আসামাত্রই নিষ্পত্তি করছেন। কোনো ধরনের সিরিয়াল ভঙ্গ করে টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই।

শিক্ষকদের কষ্ট লাঘবের বিষয়ে উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিচালক অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। ফান্ডের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করছি। টাকা পাওয়া সাপেক্ষে আমরা আবেদন নিষ্পত্তি করতে পারব। ৬ হাজার কোটি টাকা পেলে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সব আবেদন নিষ্পত্তি করতে পারব।’

Manual5 Ad Code

অবসর সুবিধা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, কর্মরত এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের ৬ ভাগ চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা দেওয়া হয়। এই অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই অবসর গ্রহণের পর তারা তাদের প্রাপ্য অবসর ভাতা সময়মতো পান না। অবসরের পর প্রায় চার বছর অপেক্ষা করতে হয়।

শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওর ৬ পার্সেন্ট হারে মাসে জমা হয় ৭৫ কোটি টাকা। ১২ মাসে তা দাঁড়ায় ৯০০ কোটি টাকায়। আর এফডিআর থেকে মাসে আয় ৫ কোটি টাকা। ১২ মাসে আয় ৬০ কোটি টাকা। সর্বমোট আয় দাঁড়ায় ৯৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে চাহিদা অনেক বেশি। প্রায় ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ঘাটতি থাকে ৪৮০ কোটি টাকার মতো।

কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদন নিষ্পত্তির কাজ চলমান। দেড় হাজার কোটি টাকা পেলে ২০২২ সাল পর্যন্ত, ৩ হাজার কোটি টাকা পেলে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা পেলে ২০২৪ সাল এবং ৬ হাজার কোটি টাকা পেলে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আবেদন নিষ্পত্তি করা যাবে।

অন্যদিকে বাজেটে অবসর বোর্ডের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ২ হাজার কোটি টাকা। অনেক শিক্ষক ধারণা করেছিলেন, এই টাকা দেওয়ার ফলে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত ভাতা পেয়ে যাবেন। কর্মকর্তারা জানালেন, সেই টাকা সরকার দিয়েছে বন্ড কেনার জন্য; যা থেকে বছরে একটা আয় আসবে। কিন্তু টাকাটা নগদ দিলে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আবেদন নিষ্পত্তি করা যেত। ২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকার থেকে বন্ড কেনার জন্য। যেখানে বছরে এক থেকে দেড় শ কোটি টাকা মতো আয় হবে, যা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত।

অন্যদিকে যাদের চাকরি অবসরের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, তাদের উদ্বেগ আরও বেশি। কারণ অবসর-পরবর্তী জীবন নিয়ে তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে হিসাব মিলছে না। চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার ঘরের অবস্থা খুবই করুণ। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। আর তিন মাস পর অবসরে যাব। আশা করেছিলাম, অবসরের টাকা দিয়ে একটা টিনশেড বাড়ি করব। খোঁজ নিয়ে জানতে পারছি, আমার চার বছর আগে যারা অবসরে গেছেন তারা এখনো টাকা পাননি। সরকার যেন আমাদের দিকে সুদৃষ্টি দেয়।’

 

দূরদর্শিতার অভাবে তহবিল-সংকট!

দূরদর্শিতার অভাবে এই ভোগান্তি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সঠিক চিন্তা না করে ২০০৫ সাল থেকে অবসর সুবিধার বিষয়টি চালু করা হয়। যেখানে শিক্ষকদের থেকে একটি অংশ কেটে রাখা হয়। কিন্তু বাকি অর্থ কীভাবে আসবে তা নিয়ে চিন্তা করা হয়নি। এ জন্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যারা বিগত সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা উদ্যোগী হয়ে সরকারের কাছ থেকে আলাদা করে পর্যাপ্ত অর্থ আনতে ব্যর্থ হন।

অবসর বোর্ডের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, প্রবিধানমালা-২০০৫-এর উপ-প্রবিধান-১০(১) অনুযায়ী এমপিওভুক্ত অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর সুবিধা প্রদান বর্তমানে চালু আছে। প্রবিধান-১০-এর(৪) অনুযায়ী ১ জানুয়ারি ১৯৮০ সাল থেকে ও প্রবিধান-১০-এর(৭) মোতাবেক ২৫ বছর এমপিওভুক্ত চাকরি গণনা করে সর্বশেষ বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রাপ্যতা নির্ধারণ করে অবসর সুবিধা দেওয়া হয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের থেকে চাঁদা কর্তন করা হয় ২০০৫ সাল থেকে, কিন্তু সুবিধা দেওয়া হচ্ছে ১৯৮০ সাল থেকে। মূলত এই কারণে ঘাটতির অঙ্ক বড়।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code