প্রজন্ম ডেস্ক:
গাজা সংকটের দীর্ঘ দুই বছরের ভয়াবহ অধ্যায় শেষে সোমবার (১৩ অক্টোবর) সবশেষ ২০ জন ইসরায়েলি বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। তাদের পরিবারের সঙ্গে মিলনের দৃশ্য ছিল আবেগঘন, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কেড়েছে। এ সময় মিসরে বিশ্বের বিভিন্ন নেতারা গাজার ভবিষ্যত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী ধাপ নিয়ে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছেন।
এ ঘটনায় প্রথমবারের মতো হামাস এবং তাদের জোটগোষ্ঠী গাজায় কোনো জীবিত বন্দি রাখছে না। একই সঙ্গে সোমবার ইসরায়ল ১ হাজার ৭১৮ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ ছাড়া কারাগারে ছিলেন। এছাড়া দীর্ঘ মেয়াদী সাজা ভোগকারী ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
সোমবার মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরায়েলের নেসেটে ভাষণ দেওয়ার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘দীর্ঘ ও কষ্টদায়ক রাতের পর অবশেষে নতুন সূর্যোদয়।’ তিনি বলেন, এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি ঐতিহাসিক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ট্রাম্পের ভাষণ অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর এবং গাজার যুদ্ধে অন্তরায় শেষ। তবে তার ২০-দফা পরিকল্পনার কিছু বিষয় এখনও সমাধান হয়নি।
জিম্মিদের মুক্তি
সোমবার ২০ জন জীবিত জিম্মিকে দুই দলে মুক্তি দেওয়া হয়। ইসরায়েলে এতে আনন্দের জোয়ার বইছে। তেল আবিবের হোস্টেজ স্কয়ারে মানুষ পতাকা নেড়ে ‘ধন্যবাদ, ট্রাম্প!’ বলে উল্লাস করেছে।
ইসরায়েলের দক্ষিণে রে’ইম সামরিক ঘাঁটিতে জিম্মিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। নোভা মিউজিক ফেস্টিভ্যাল থেকে অপহৃত ২৪ বছরের গাই গিলবোয়া-দালাল তার বাবা-মা ও ভাইবোনের সঙ্গে কেঁদে আলিঙ্গন করেছেন।
৪৮ বছরের ওমরি মিরান, যিনি নাহাল ওজ থেকে অপহৃত হয়েছিলেন, তার স্ত্রী ও বাবার সঙ্গে দেখা করেছেন। ছবিতে দেখা গেছে, তিনি দুই বছর পর সন্তানদের সঙ্গে খেলছেন।
চুক্তি অনুযায়ী, হামাসকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব জিম্মি, জীবিত ও মৃত, মুক্তি দেওয়ার কথা। সোমবার হামাস রেড ক্রসের কাছে চারটি মৃত জিম্মির দেহ হস্তান্তর করেছে। এগুলো তেল আবিবের ফরেনসিক ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। তাদের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হয়নি।
ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি
ইসরায়েল সোমবার ১ হাজার ৭১৮ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে, যাদের কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করা হয়েছিল। তারা বাসে করে গাজার নাসের হাসপাতালে ফিরেছেন, যেখানে জনতা তাদের স্বাগত জানিয়েছে।
এ ছাড়া ২৫০ জন দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিছু বন্দি ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রামাল্লায় ফিরে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। সেখানে ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনী ও চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স সোসাইটি জানিয়েছে, ১৫৪ জন বন্দিকে মিসরে নির্বাসিত করা হয়েছে। ইসরায়েল বলেছে, হিংসাত্মক অপরাধে দোষী বন্দিদের গাজা বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ফেরানো যাবে না।
ট্রাম্পের ভাষণ
ট্রাম্প এক ঘণ্টার বেশি কনেসেটে ভাষণ দেন, যেখানে যুদ্ধবিরতি চুক্তির সাফল্য উদযাপন করেন। তিনি বারবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুকে যুদ্ধ পুনরায় শুরু না করার পরামর্শ দেন। ট্রাম্প বলেন, ‘ইসরায়েল আমাদের সাহায্যে যুদ্ধে জিতেছে। এখন শান্তি ও সমৃদ্ধির সময়।’ তিনি আরও সতর্ক করেন, নতুন যুদ্ধ নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
বিশ্বনেতাদের মিসরে বৈঠক
ট্রাম্প মিসরে যান এবং কাতার, জর্ডান, প্যালেস্টাইনি অথরিটি, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা শার্ম এল-শেখ রিসর্টে গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি এবং শান্তি পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ নিয়ে সমঝোতায় বসেন। বিশ্বনেতারা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেন। তবে নেতানিয়াহুকে সেখানে ডাকলেও তিনি যাননি।
যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ
যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় তৈরি ২০-দফা পরিকল্পনায় গাজার পরিচালনা, হামাসের অস্ত্র ত্যাগ এবং ইসরায়েলের প্রত্যাহারের মতো কিছু বিষয় এখনও অসম্পূর্ণ।
চুক্তি অনুযায়ী, হামাসের অস্ত্র ত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল পূর্ণ প্রত্যাহার করবে না। হামাসের প্রধান আলোচক খলিল আল-হাইয়া বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থকারা নিশ্চিত করেছে, এই চুক্তি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করে, সাময়িক যুদ্ধবিরতি নয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গাজায় পরিচালনা, নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা এবং মানবিক সহায়তার বিতরণ নিশ্চিত করতে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় সব পক্ষ ট্রাম্পের পরিকল্পনা সফল করতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে।
Sharing is caring!