প্রজন্ম ডেস্ক:
অদৃশ্য বাধায় কাজ করতে পারছে না প্রশাসন। পদোন্নতি-পদায়নের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ‘জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটি’র সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে নানা বাধার মুখে পড়ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রশাসনসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞরা মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল নিজেদের লোকজনকে ‘জায়গামতো’ বসাতে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। সে কারণেই প্রশাসনের নৈমিত্তিক কাজে গতি আসছে না। অনেকটা চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা তৈরি হয়েছে সেখানে।
প্রশাসন বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপে পড়েছে প্রশাসনের ‘চেইন অব কমান্ড’। শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই সতর্কতার সঙ্গে পথ চলার নীতি গ্রহণ করেছেন। নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী কারা, তা বোঝার চেষ্টা করছেন এই কর্মকর্তারা। সে অনুযায়ী নিজেদের কর্মকৌশল নির্ধারণ করছেন তারা। এতে সরকার বা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে হিসেবে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য সরকার গঠন বা রাষ্ট্রক্ষমতার সমীকরণ জোরালো হচ্ছে। নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় যেহেতু প্রশাসন বিভাগ বেশ গুরুত্ব বহন করে থাকে, তাই আগে থেকেই ক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যাশী বড় দুটি রাজনৈতিক দল ‘নিজেদের লোক’ বিভিন্ন দপ্তরে বসানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। তারা এখন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিতে নানা রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে প্রশাসনে আলোচনা রয়েছে।
মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ পদ- জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। গত ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম, ফেনী, মাদারীপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ডিসি নিয়োগ দেওয়ার পরই তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়। একইভাবে ২১ সেপ্টেম্বর নওগাঁর ডিসিকে চট্টগ্রামে বদলি করা হলে তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন মহলে প্রচার রয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তাকে সেই পদে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পদগুলো শূন্য রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের পদ শূন্য হয় গত ২১ সেপ্টেম্বর, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব পদটি শূন্য হয় ২৮ সেপ্টেম্বর, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব পদটি শূন্য হয় ২৮ আগস্ট, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব পদটি শূন্য হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। আর সমবায় বিভাগের সচিব পদটি শূন্য রয়েছে গত ২৬ মার্চ থেকে।
এর মধ্যে ১২ অক্টোবর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হককে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এবং বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব মো. কামাল উদ্দিনকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সচিবালয়ে গুঞ্জন রয়েছে, বড় একটি রাজনৈতিক দল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তাদের মতাদর্শের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে সক্ষম হলেও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাকে নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের এপিডি পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই এই মন্ত্রণালয়ে আনা হয়।
তবে গত ১০ দিন ধরে তাকে এপিডি পদে নিয়োগ দিতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ফিরোজ সরকার প্রসঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভাগীয় কমিশনার পদ থেকে এপিডি পদে পদায়নের জন্য বদলি আদেশ হওয়ার পরপরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এই কর্মকর্তাকে সাবেক কর্মস্থল থেকে রিলিজ না নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তারপর রিলিজ নিয়ে তিনি জনপ্রশাসনে যোগ দিলেও এখনো তাকে এপিডি পদে নিয়োগ দিতে দেয়নি অদৃশ্য শক্তি।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার মতে, ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং সম্প্রতি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে ধর্মভিত্তিক একটি দল তাদের মতাদর্শের কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার সাফল্য পেয়েছে, যা বড় রাজনৈতিক দলটি পায়নি। এই চার মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় হিসেবে বিবেচিত।
কর্মকর্তারা ভাবছেন, সরাসরি আইনগত সুবিধা নেওয়ার কোনো সুযোগ না থাকলেও প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং সারা দেশের মাঠ প্রশাসনে ইতোমধ্যে অদৃশ্য প্রভাব বিস্তারের পর বাকি সুযোগও নিতে চেষ্টা করছে ধর্মভিত্তিক দলটি। তাছাড়া স্বরাষ্ট্র সচিবের মাধ্যমে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি নিজেদের মতো করে সাজানোর সুযোগও রয়েছে। পাশাপাশি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিজেদের আদর্শিক কর্মকর্তা নিয়োগে সাফল্য পাওয়ায় ধর্মভিত্তিক দলটি ভোটের আগে সারা দেশের উপাসনালয়গুলো ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচার চালাতে এবং নিজেদের ভোটব্যাংক বাড়াতে কাজে লাগাতে পারে।
এদিকে জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটি নিয়মিত ব্যাচ হিসেবে প্রশাসনের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। একই সঙ্গে ২৪তম ব্যাচের পদোন্নতি রিভিউ করে আরও কিছু কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশও অদৃশ্য কোনো কারণে থেমে আছে একই প্রক্রিয়ায়।
কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রকৃত পক্ষে একটি রাজনৈতিক দল ধারণা করছে পদোন্নতি দিলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সুবিধা পাবে। আবার ধর্মভিত্তিক দলটি ভাবছে, পদোন্নতি পাবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের ঘরানার কর্মকর্তারা। এই জটিলতায় আটকে আছে এই দুই ব্যাচের পদোন্নতি।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বর্তমানে ডিসি পদে ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা রয়েছেন ২০ জন, ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা রয়েছেন ২১ জন ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা রয়েছেন ২৩ জন। যুগ্ম সচিব পদে ২৪তম ব্যাচের পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা এখনো জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
পাশাপাশি ২৫তম ও ২৭তম ব্যাচের বেশ কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ থাকলেও এসব কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করতে পারেনি সরকার। যদিও ইতোমধ্যে এই দুই ব্যাচের আরও বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ডিসি পদে নিয়োগের লক্ষ্যে ফিট লিস্টে রাখা হয়েছে। তাছাড়া এরই মধ্যে ২৮তম ব্যাচের আরও কিছু কর্মকর্তাকে সম্প্রতি ডিসি পদে পদায়নের জন্য ফিট লিস্টে নির্বাচিত করে রাখা হয়েছে। গুঞ্জন রয়েছে, ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের ফিট লিস্ট তৈরি করা হয়েছে নির্বাচনের সময় ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কর্মকর্তারা কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ বাস্তবায়নের কাণ্ডারি হতে পারেন না। অথচ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাপ্রত্যাশী দুই বড় রাজনৈতিক দলই সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলার উপক্রম করেছে। একইভাবে প্রশাসনেরও এক শ্রেণির কর্মকর্তা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার লোভে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাভাজন হওয়ার প্রতিযোগিতায় রয়েছেন।
এসিব বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দক্ষ, যোগ্য, নিরপেক্ষ প্রশাসন কামনা করেছিল দেশের জনগণ। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বরং পুরো প্রশাসনই এখন দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে প্রভাবিত হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শে প্রশাসন সাজানোর উদ্যোগ নেয়। এটা সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ফলে যোগ্য, দক্ষ, নিরপেক্ষ কর্মকর্তার পরিবর্তে পুরো প্রশাসনে দায়িত্ব পেয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শের কর্মকর্তারা। এতে যোগ্য, দক্ষ, নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
মো. ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, আগের রাজনৈতিক সরকারও যোগ্য, দক্ষ, নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের যেভাবে যতটুকু মূল্যায়ন করেছে, এই সরকার সেটাও করতে পারছে না। আর বিশেষ সুপারিশের লোকদের নিয়োগের জন্য প্রকৃত কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়ন হওয়ায় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। স্বাধীনতার পর এত দুর্বল প্রশাসন এই দেশবাসী কখনো দেখেনি।
দীর্ঘদিন সচিবশূন্যতা প্রসঙ্গে ফিরোজ মিয়া বলেন, এটা অসম্ভব একটি ব্যাপার, যা আগে কখনোই প্রশাসনে ঘটেনি। সচিব শূন্য থাকায় মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং এর অধীন দপ্তর বা সংস্থাও অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে সেবাবঞ্চিত হয় দেশ ও তার জনগণ।
৯ সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসর
৯ সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে সরকার। তাদের মধ্যে দুজন সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাও রয়েছেন। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক ৯টি প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গত রাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপনগুলো প্রকাশ করে। সব প্রজ্ঞাপনেই বলা হয়েছে, তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, এই ৯ সচিবের চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সরকার মনে করছে, জনস্বার্থে তাদের সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেওয়া প্রয়েজন। তাই সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে তাদের অবসর দেওয়া হয়েছে। বিধি অনুযায়ী তারা অবসরজনিত সুবিধাদি পাবেন।
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হলেন, সচিব শফিউল আজিম (৬৩৬৫), সচিব ড. এ কে এম মতিউর রহমান (৭৬৩১), সচিব ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ (৬০৬৫), সচিব মো. নূরুল আলম (৫৯৯৪), সচিব মো, আজিজুর রহমান (৫৯২৯), সচিব মো. মিজানুর রহমান, এনডিসি (৫৯২৪), সচিব মো. সামসুল আরেফিন (৫৭৭৩), সিনিয়র সচিব মো. মশিউর রহমান, এনডিসি (৫৫৬৮) ও সিনিয়র সচিব মো. মনজুর হোসেন (৫৪৯০)।
Sharing is caring!