প্রজন্ম ডেস্ক:
ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজের ভেতর এখন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। দেয়ালে পোড়া ক্ষত। ভেতরে লোহার তৈরি বিভিন্ন সেলফ, গ্রিল ও খুঁটি-খাম্বা সবই আগুনের তাপে মুচড়ে বেঁকে গেছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন পোড়া সরঞ্জাম ও পণ্য রাখার আসবাব-কাঠামো। এসব পোড়া ধ্বংসস্তূপের পাশেই কার্গো ভিলেজের ৯ নম্বর গেট দিয়ে গতকাল শুরু হয় পণ্য খালাস প্রক্রিয়া।
সোমবার (২০ অক্টোবর) দুপুর ১টায় সেখানে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। বেশ কিছু সময় সেখানে অবস্থানকালে দেখা যায়, গতকালও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, যারা প্রায় সবাই বিভিন্ন তদন্ত কমিটির প্রতিনিধি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মালামাল পুড়ে গেছে বলে খবর প্রকাশ হওয়ায় সেখানে গতকাল হাজির হন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থার প্রতিনিধিরা। পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অনেক বড় একটি টিম সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে।
আগুন নেভানোর অভিযানে অংশ নেওয়া একাধিক ফায়ার সার্ভিসের কর্মী জানান, পোড়া কার্গো ভিলেজের আমদানি কমপ্লেক্সের ভেতর গতকালও তাপ ও গরম অনুভূত হচ্ছিল। ভেতর-বাইরে যা কিছু ছিল, সবই পুড়ে ছাই বা ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনের তাপে ভবনের দেয়ালগুলো দুর্বল হয়ে গেছে।
এদিকে আগুনের ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং সদস্যসচিব করা হয়েছে ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিনকে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে দেখা যায়, গতকালও অগ্নিকাণ্ডের স্থলে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। কাজ করতে দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিটকে। পূর্ব পাশে কুরিয়ারের সামনে কার্গো কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকে নৌবাহিনী, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কর্মী ও আনসারদের পাহারায় দেখা গেছে। পাশের ফুটপাতে মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ। গতকাল থেকে শাহজালালের ফ্লাইট শিডিউল স্বাভাবিক হওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ধীরে ধীরে যাত্রীদের ভোগান্তিও অনেকটা কমে আসে।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত আমদানি কার্গো ভিলেজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বেশ কিছু পণ্য এসেছিল। সেগুলো আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না, সেটি দেখতে গতকাল দুপুরে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থা রসাটমের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকার বিমানবন্দরে এসেছিল। তারা ভেতরে পরিদর্শন করেন এবং দুপুরের দিকে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেট দিয়ে বের হয়ে চলে যান। তবে সেই পণ্যগুলো আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এরপর বেলা ২টা ৫০ মিনিটে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিভিন্ন আলামত সংগ্রহের জন্য বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটে এসে হাজির হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ইউনিটের বড় একটি টিম এসেছিলেন। বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেট দিয়ে সিআইডির তিনটি জিপ ও একটি বড় বাস ভেতরে প্রবেশ করেছিল। ওই বাসে অনেক সিআইডি সদস্যকে বসে থাকতে দেখা যায়।
গতকাল বেলা ২টায় দেখা যায়, বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজের ৯ নম্বর গেটের সামনে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) প্রতিনিধিদের ভিড়। আমদানি পণ্য খালাসের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। গেটের এক প্রান্তে প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমদানি প্রতিষ্ঠান মাল্টি টিচ কোম্পানির প্রতিনিধি মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আজ (সোমবার) দুই টনের মতো গার্মেন্টস আইটেমের পণ্য খালাসের কথা রয়েছে। দুপুর পর্যন্ত পণ্য বের হয়নি। যেহেতু খালাস প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাই এখনো অপেক্ষায় আছি।’
রিমার্ক এইচবি লিমিটেডের প্রতিনিধি মো. ইজার আলী বলছিলেন, ‘আমাদের পণ্য গত ১৮ অক্টোবর নেমেছিল। সেগুলো কার্গোতে ছিল না বলেই রক্ষা পেয়েছে। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার বিভিন্ন স্পেয়ার পার্টস ও কসমেটিকস আইটেম ছিল। সেটি আজ সোমবার খালাস করা যাবে কি না তা জানতে এসেছি।’
গতকাল ৯ নম্বর গেটে কর্তব্যরত এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক), আনসার সদস্য ও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, আগুনের ঘটনায় আমদানি কার্গো ভিলেজে থাকা সব পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে এর পর থেকে কার্গো বিমানযোগে যেসব বাণিজ্যিক পণ্য বিমানবন্দরে নামানো হয়, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত কার্গো ভিলেজের পাশেই রাখা হয়। সেই পণ্যগুলো খালাস করা সোমবার থেকে শুরু হয়েছে। এদিকে কার্গো ভিলেজের কর্মীরাও আসতে শুরু করেছেন। তারা ভেতরে কাজ করছেন।
এভসেকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের এখানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা শিফটিং করে কাজ চলবে, যাতে আমদানিকারকদের প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো খালাস করা যায়।’
আমদানি কার্গো ভিলেজের ৯ নম্বর গেটে কর্মরত এভসেক সিকিউরিটির বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট স্বপন আরান বলেন, ‘আমদানি করা মালামাল বের হওয়া শুরু হয়েছে। ভেতরে কাস্টমসের লোকজনও তাদের কার্যক্রম শুরু করেছেন। তবে পণ্য খালাস কার্যক্রম আগের তুলনায় অনেক কম। ধীরে ধীরে হয়তো বাড়বে। দুপুর থেকেই পণ্য খালাসের জন্য সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধি ও আমদানিকারক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আসা শুরু করেছেন।’
এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব মো. জাকির হোসেন। গতকাল সকালে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি।
একই অনুষ্ঠানে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আলী বলেন, ‘কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য বড় ক্ষতি। এই ঘটনায় আমরা শঙ্কিত এবং বৈদেশিক ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন। এতে বোঝা যায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’ ওই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের নেতারা বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডের দায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি), কাস্টম হাউস ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কেউই এড়াতে পারে না।
এদিকে দেশের প্রধান বিমানবন্দরে স্মরণকালের ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ব্যাপক। কিন্তু সেই ক্ষয়ক্ষতিতে সর্বস্ব হারানোর মতো কোনো চিত্র দেখা যায়নি আগুনে ধ্বংস হওয়া বিভিন্ন পণ্যের মালিক বা ব্যবসায়ীদের মাঝে। গতকাল রবিবার সরেজমিন কয়েক ঘণ্টা কার্গো ভিলেজের সামনে অবস্থান করে বিষয়টি বোঝা যায়।
সাধারণত অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু শাহজালালের কার্গো ভিলেজের (আমদানি) আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ ব্যবসায়ী চিন্তামুক্ত ছিলেন কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, যেসব মালামাল বা পণ্য পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই বিমার আওতায় ছিল। ফলে খুব সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাদের পুড়ে ধ্বংস বা নষ্ট হয়ে যাওয়া মালামাল-পণ্যের সমমূল্যের অর্থ পেয়ে যাবেন। দু-একজন ছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত কারও মুখেই সেভাবে চিন্তার ভাঁজ লক্ষ করা যায়নি। বরং সুযোগ কাজে লাগাতে কেউ কেউ তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
Sharing is caring!