স্টাফ রিপোর্টার:
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যার্বতনের অপেক্ষায় রয়েছে বিএনপি। দলটির মধ্যে আলোচনা হলো; সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখে তিনি দেশে ফিরতে পারেন। আর তার দেশে ফেরার এক মাসের মধ্যেই জাতীয় কাউন্সিল করতে চান নীতিনির্ধারকরা।
সূত্রমতে, ওই হিসাব বিবেচনায় নিয়ে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই জাতীয় কাউন্সিলের দিনক্ষণের ঘোষণা আসতে পারে।
দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কাউন্সিল নিয়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যাগ না থাকলেও স্থায়ী কমিটিতে এ নিয়ে আলোচনা আছে। তবে কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিতে বেশ সময়ের প্রয়োজন। এখন সিদ্ধান্ত নিলেও অন্তত তিন-চার মাস সময়ের প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ও সময়সাপেক্ষ। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে কাউন্সিল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা আছে। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ জন্য এখনো চূড়ান্ত তারিখ ঠিক হয়নি। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও দেশে নেই। তার ফেরার প্রতীক্ষায় রয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য বলেন, সব মিলিয়ে ৯ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে অন্তত তিনটি কাউন্সিল করা যেত। বর্তমানে কাউন্সিল করার ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। এখন কাউন্সিল করার মতো পরিবেশ থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে নেই। তাকে ছাড়া কীভাবে কাউন্সিল করব? তিনি দেশে ফেরার পরই দ্রুতসময়ের মধ্যে কাউন্সিল হবে। আগে থেকেই সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হবে।
দলীয় সূত্রমতে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দলকে শক্তিশালী করতে জাতীয় কাউন্সিল করার কথা ভাবছে বিএনপি। এতে করে দল এবং সারা দেশের নেতা-কর্মীরা চাঙা ও উজ্জীবিত হবেন। শেখ হাসিনার পতনের পর দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা করেছেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা। তাই কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো নিয়ে প্রায় দিনই আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করতে আদালতে যাচ্ছেন আইনজীবীরা।
জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। দলের গঠনতন্ত্রে তিন বছর পরপর সম্মেলনের কথা থাকলেও গত ৯ বছরে তা হয়নি। এই সময়ে শুধু কাউন্সিল নয়, কোনো উপকমিটিও গঠন করতে পারেনি দলটি। ফলে দলীয় নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ছিটকে পড়ছেন অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা। আবার এক নেতার দখলে রয়েছে একাধিক পদ। এতে বিএনপিতে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না বলে পদপ্রত্যাশী ও তৃণমূল নেতাদের দাবি। জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে কিছু বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকীয় পদ আছে। কিন্তু পদে থাকা নেতাদের কার্যক্রম একেবারেই সীমিত। এ জন্য বিষয়ভিত্তিক উপকমিটিগুলো করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দীর্ঘ ৯ বছরে কেন কাউন্সিল হয়নি জানতে চাইলে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের কারণে কাউন্সিল করা যায়নি। অতীতের এই সময়ে আওয়ামী লীগের পদে পদে বাধা ও নিপীড়নের মুখে পড়েছে শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূলের কর্মী পর্যন্ত। এমন কোনো নেতা ছিল না যার নামে মামলা দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দলকে শক্তিশালী করা ও পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে হাইকমান্ড। তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল, ওলামা দল, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর, খুলনা জেলাসহ আরও কয়েকটি জেলার কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য তারা বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের ফেরার পরই জাতীয় কাউন্সিল করা উচিত। তাকে ছাড়া কাউন্সিল হলে তা হবে সাদাসিধে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান উপস্থিত থাকবেন। সেই ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দ্রুত সাংগঠনিক কার্যক্রমও জোরদার করা হয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, গত ৯ বছর কাউন্সিল করার মতো পরিবেশ ছিল না। খালেদা জিয়া বন্দি ছিলেন, তারেক রহমান বিদেশে নির্বাসিত ছিলেন। ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন কাউন্সিল করার ব্যাপারে আলোচনা চলছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়েই কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই তারিখ জানা যাবে।
কাউন্সিল নিয়ে আছে মত-দ্বিমত
দলের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে বিএনপির ভেতরে মত-দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এখনই কাউন্সিল করলে নেতৃত্বের কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। যার প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর। আবার কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘ ৯ বছর দলের কাউন্সিল না হওয়ায় নতুন নেতৃত্বও উঠে আসতে পারেনি। তাই বর্তমান পরিস্থিতি দলের কাউন্সিল করার উপযুক্ত সময়। এতে নির্বাচন কমিশনের আরপিও লঙ্ঘনের দায়ে দলের নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকিও এড়ানো যাবে। কারণ বিএনপির গঠনতন্ত্র ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর তিন বছর পরপর কাউন্সিল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই হিসেবে অন্তত তিনটি কাউন্সিলের সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাই দেরি করা ঠিক হবে না। কাউন্সিল না হলে আগামী নির্বাচনে জটিলতা হতে পারে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বিএনপিতে নানা মতের ব্যক্তি রয়েছেন। মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে হাইকমান্ড পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। বিএনপি সবার মতামতকে গুরুত্ব দেয়। কারণ নানা মত ও সমালোচনা থেকে উত্তম মতকে বাছাই করা সহজ হয়।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, কাউন্সিল নিয়ে দলের মধ্যে কোনো পক্ষ নেই, বিভেদ-ক্ষোভ নেই। তবে নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা রয়েছে। বড় দলে প্রতিযোগিতা থাকবে, এটা স্বাভাবিক।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে একাধিক পদ শূন্য
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে তিনটি পদ ফাঁকা রয়েছে। বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদের ১৮টি, উপদেষ্টা পরিষদের ২০টি এবং সম্পাদক ও সহসম্পাদক মিলে ১২০টির মতো পদ খালি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর মধ্যে আইন, যুব, জলবায়ু পরিবর্তন, মহিলা, ছাত্রবিষয়ক সহসম্পাদক, তথ্য ও গবেষণা সহসম্পাদকের পদ খালি রয়েছে। যুববিষয়ক ও ছাত্রবিষয়ক সহসম্পাদকের পদ আট বছরেও পূর্ণ হয়নি। আর বাকিগুলো পদোন্নতি, মৃত্যু, বহিষ্কার এবং পদত্যাগজনিত কারণে শূন্য হয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায় বার্ধক্য, অসুস্থতাসহ নানা কারণে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও কয়েকজন সদস্য ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। নির্বাহী কমিটির অনেকে অসুস্থ ও বয়সের কারণে নিষ্ক্রিয়। অনেকে জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করায় কেন্দ্রে সময় দিতে পারেন না। আবার কেউ কেউ কেন্দ্রে থাকলে এলাকায় সময় দিতে পারেন না। ফলে নির্বাহী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণ এবং এক নেতার এক পদ কার্যকর করা সময়ের দাবি বলে মনে করেন দলের নেতা-কর্মীরা।
দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা এবং দলীয় জনশক্তির পদায়নের লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক একাধিক উপকমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু কাউন্সিলের ৯ বছরেও তা সম্পন্ন করতে পারেনি দলটি। বিএনপির গঠনতন্ত্রে বিষয়ভিত্তিক ২৬টি উপকমিটি গঠনের কথা থাকলেও মাত্র দুটি উপকমিটি গঠিত হয়েছে। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরেই রয়েছে নানা প্রশ্ন। ফলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গবেষণাসহ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বিএনপিকে বেগ পেতে হয়। সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল এবং অঙ্গসংগঠনের কমিটির পুনর্গঠন করা হলেও বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি গঠনের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
বিএনপির উপকমিটি গঠন প্রসঙ্গে গঠনতন্ত্রের ৬নং অনুচ্ছেদের ১৩নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘দলের চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনবোধে জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্য থেকে কয়েকজনের সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কমিটি মনোনীত করতে পারবেন। তবে এ সময়ের মধ্যে ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট ‘নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম’, ২০২২ সালের ২০ জুন ‘মিডিয়া সেল’ এবং ২০২৪ সালের ২২ মার্চ ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ নামে পৃথক একটি সেল গঠন করেছে বিএনপি।
Sharing is caring!