প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৪ঠা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

যে জুলাই ছিল ‘৩৬ দিনের’

editor
প্রকাশিত জুলাই ১, ২০২৫, ০৮:০৮ পূর্বাহ্ণ
যে জুলাই ছিল ‘৩৬ দিনের’

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual5 Ad Code

২০২৪ সালের জুলাই মাস ৩১ দিনের হলেও ক্যালেন্ডারের পাতায় তাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আন্দোলনের উত্তাপে মাসটি হয়ে উঠেছিল ৩৬ দিনের দীর্ঘ এক সংগ্রামের নাম। এই ‘৩৬ জুলাই’ শুধু একটি প্রতীকী তারিখ নয়— এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য নতুন অধ্যায়। রক্তাক্ত সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ‘৩৬ জুলাই’ হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের মুহূর্ত।

জুলাই-আগস্টের পালাবদলের শুরুটা হয়েছিল ৫ জুন, যখন হাইকোর্ট এক রায়ে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। রায়ের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তারা একে ‘বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য’ হিসেবে উল্লেখ করে সোচ্চার হতে থাকেন। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল বের হয়, যা পরদিন আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করে। প্রতিবাদের এই স্ফুলিঙ্গ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই থেমে থাকেনি। ক্রমেই তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

এর মধ্যেই ঈদের ছুটির কারণে আন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে। তবে ১ জুলাই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দিন থেকেই আন্দোলন ফিরে আসে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে। শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন, যা দ্রুতই জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। নেতৃত্বহীন কাঠামো এবং সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই আন্দোলন হয়ে ওঠে নতুন ধারার গণসংগ্রাম।

৪ জুলাই, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। পরদিন থেকে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি। ৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘোষণা আসে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির, যা ৭ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। এই কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে সড়ক ও রেলপথে অবরোধ তৈরি হয়, অচল হয়ে পড়ে জনজীবন।

Manual2 Ad Code

১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে। কিন্তু তাতেও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। বরং শুরু হয় সহিংসতা, যা পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। ১৪ জুলাই, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে ঘিরে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। তিনি গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন— ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতি-পুতিরা কেউ মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারা মেধাবী?’ এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন করে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয়।

১৫ জুলাই ঢাবিতে ছাত্রলীগের হামলায় বহু শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর ঢামেকে আহতদের ওপর আবারও হামলা হয়। একই রাতে জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের আরেকটি হামলা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। রংপুরে সংঘর্ষে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তাকে গুলি করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এর পরপরই জনতার ক্ষোভ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ওই রাতেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার, কিন্তু তাতে আন্দোলন থামেনি। বরং শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বের করে দেন, ঘোষণা করেন ‘রাজনীতিমুক্ত’ ক্যাম্পাস।

১৭ ও ১৮ জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। ঢাকা শহর তখন রূপ নেয় এক যুদ্ধক্ষেত্রে। সেদিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে, যার ফলে অন্তত ২৯ জন নিহত হন। সরকারপ্রধান প্রস্তাব দেন ২০ শতাংশ কোটা রাখার, কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সংযোগ।

১৯ জুলাই ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। হাসপাতালগুলোতে লাশের স্তূপ জমতে থাকে, শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। মেট্রোরেল স্টেশন, এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, নরসিংদীর জেলখানা—সবখানেই সহিংসতা ও প্রতিরোধের চিত্র দেখা যায়। শেষমেশ জারি হয় কারফিউ, সেনাবাহিনী নামে রাস্তায়।

Manual2 Ad Code

কিন্তু এত কিছুর পরও আন্দোলন থেমে থাকেনি। বরং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এটিকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়। প্রতিবাদের এই ঢেউ থেমে থাকেনি ৩১ জুলাইয়ে। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে তা এগিয়ে গেছে আরও একদিন। শহীদ, প্রতিবাদ, প্রতিশোধ— সবকিছু মিলিয়ে এক মাস পরিণত হয় এক ঐতিহাসিক ৩৬ দিনে। কারণ জনগণ জানিয়ে দেয়—জুলাই তখনও শেষ হয়নি, যতক্ষণ না বিজয় আসে।

অবশেষে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারের সমাবেশে ঘোষণা আসে—সরকার পতনের এক দফা। ৪ আগস্ট ঘোষিত হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি, যা একদিন এগিয়ে এনে নির্ধারণ করা হয় ৫ আগস্টে এবং সেই দিন—৫ আগস্ট; যা ইতিহাসে লেখা হয় ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে, ছিল দীর্ঘতম প্রতিবাদের বিজয় দিন। লাখো মানুষ ঢাকায় সমবেত হয়, পথে নামে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে। সেদিন দুপুরের আগেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। শেষ হয় একটি অধ্যায়ের, সূচনা হয় নতুন একটি সময়ের— তারুণ্যের, সাহসের, সমতার ও পরিবর্তনের সময়।

Manual4 Ad Code

এই আন্দোলন শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি একটি প্রজন্মের জাগরণ। যে প্রজন্ম দীর্ঘদিন রাজনীতি ঘৃণা করে বেড়ে উঠেছিল, তারা বুঝে যায়— রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে বাঁচা যায় না, বরং রাজনীতিকে বদলে দিয়েই বাঁচতে হয়। এই উপলব্ধি থেকেই তারা হয়ে ওঠে বিপ্লবী, আর সেই বিপ্লবের নাম—৩৬ দিনের এক জুলাই।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code