প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১লা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

জনশক্তি রফতানি স্থবির

editor
প্রকাশিত আগস্ট ২৬, ২০২৫, ০৮:২৪ পূর্বাহ্ণ
জনশক্তি রফতানি স্থবির

Manual7 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

দেশের জনশক্তি রফতানির বড় গন্তব্য সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ওমান, কাতার, কুয়েত সরকারও বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ কমিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অভিবাসন খাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপর্যয় এড়াতে নতুন শ্রমবাজার তৈরি করা জরুরি।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়া, পর্তুগাল, মাল্টা, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে নতুন বাজার খুঁজছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

Manual3 Ad Code

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মোট ১৬৮টি দেশে জনশক্তি রফতানি করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজার ৭২১ জন কর্মী গেছেন বিভিন্ন গন্তব্যে। এর মধ্যে সৌদি আরবে ৩ লাখ ৪ জন, ইউএইতে ২ হাজার ৯৯৩ জন, কুয়েতে ১১ হাজার ১১ জন, ওমানে ৪৩ জন, কাতারে ৪০ হাজার ৩০৮ জন, লেবাননে ২ হাজার ১৮১ জন, জর্ডানে ৪ হাজার ৯২৬ জন, লিবিয়ায় ২ জন, সুদানে ৩৮ জন, মালয়েশিয়ায় ২ হাজার ৪৮৬ জন, সিঙ্গাপুরে ২৬ হাজার ৩৮৯ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৮৪০ জন, যুক্তরাজ্যে ৩৪৬ জন, ইতালিতে ২ হাজার ৩৫ জন, জাপানে ৪৫৪ জন, ইরাকে ২০৪ জন এবং অন্যান্য দেশে ২৬ হাজার ৪৫৪ জন বাংলাদেশি কর্মী গেছেন। গত বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৫৬ জন কর্মী বিভিন্ন গন্তব্যে যান, যা বার্ষিক হিসাবে দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে দক্ষ (তাকামুল) জনশক্তি পাঠাতে না পারার কারণে গত কুরবানির ঈদের পর থেকে দেশটি কর্মী নেওয়া বন্ধ রেখেছে। দক্ষ কর্মী নেওয়ার জন্য সৌদি সরকার ২০২২ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেছে। ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ৫টি ট্রেডে পাইলট প্রকল্পের আওতায় দক্ষতা যাচাই শুরু করে সৌদি সরকার। দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ১১১টি সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দক্ষ কর্মী তৈরিতে বাস্তবমুখী উদ্যোগ না নেওয়ায় সৌদির চাহিদা অনুযায়ী কর্মী পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে সৌদি সরকারের সঙ্গে নতুন চুক্তি করছে সরকার। এরই মধ্যে নতুন চুক্তির খসড়া দুপক্ষই অনুমোদন করেছে। সামনে সেপ্টেম্বরে রিয়াদে দুই দেশের মধ্যে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে। সৌদির সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর দেশটিতে আবারও জনশক্তি রফতানি শুরু হবে।

বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত মালয়েশিয়া। শ্রমশক্তি খাতে এ দুই দেশ যে সমঝোতা করেছে তাতে মালয়েশিয়া নির্ধারিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোই সেখানে কর্মী পাঠাতে পারবে। এ প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে সিন্ডিকেট বাণিজ্য গড়ে ওঠায় বাংলাদেশি কর্মীরা কয়েকগুণ বেশি অর্থ দিয়েও মালয়েশিয়া গিয়ে সঠিক কাজ পাননি এবং অনেককেই দেশে ফিরতে হয়েছে।

Manual6 Ad Code

চলতি মাসে প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। এই সফর থেকে সবাই আশা করেছিলেন, মালয়েশিয়া কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেট প্রথা বাতিল হবে। এ সফর থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কল্যাণ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, খরচ কমানো হয়েছে, কিন্তু সিন্ডিকেট প্রথা বাতিলের বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। মালয়েশিয়া ইতিমধ্যে বিদেশি কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, তবে বাংলাদেশ থেকে কী প্রক্রিয়ায় কর্মী যাবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। এরই মধ্যে আগের বাদ পড়া ৭ হাজার ৯০০ কর্মীকে মালয়েশিয়া বোয়েসেলের মাধ্যমে নিতে রাজি হয়েছে। তবে নতুন কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনও নির্ধারিত হয়নি।

Manual8 Ad Code

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে যত আলোচনা হয়েছে, আমরা বলেছি, সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে সুযোগ দিতে। এবার গিয়েও বলেছি, সবাইকে সুযোগ দিতে। মনোপলি হলে শ্রমিকরা প্রতারিত হন, খরচ বেড়ে যায়, অনেক ধরনের দুর্নীতি হয়। ফিলিপাইন, পাকিস্তান, নেপালের রিক্রুটিং এজেন্সি কয়েকশ, আমাদের কয়েক হাজার। এ প্রসঙ্গ যখন তোলা হয় তখন আমি ওই দেশগুলোর সমান দিতে বলি। পাকিস্তানকে ৪০০ দিলে আমাদেরও ৪০০ দেওয়ার কথা বলেছি। এ বছর শুনেছি, মালয়েশিয়া ৩০ হাজার শ্রমিক নেবে, আমরা বলেছি বোয়েসেলকে দিতে। আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে আপনাদের মনে রাখতে হবে, মালয়েশিয়া একটি সার্বভৌম দেশ। আমরা তো তাদের জোর করতে পারি না।

এদিকে ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের অনেক বদনাম আছে। ইউরোপ দক্ষ কর্মী চায়; কিন্তু বাংলাদেশি কর্মীদের বেশিরভাগই অদক্ষ। মূলত মিথ্যা তথ্য, জাল ওয়ার্ক পারমিট, ভুয়া নথিপত্র, অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রাসহ একাধিক কারণে বাংলাদেশি কর্মীদের দুর্নাম সৃষ্টি হয়েছে। অবৈধ পথে ইউরোপ পাড়ি দেওয়া কর্মীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেশনাল প্রসিডিওর (এসওপি) স্বাক্ষর করে। ওই এসওপি স্বাক্ষরের পর গত সাত বছরে ইউরোপ থেকে প্রচুর কর্মী দেশে ফিরেছে। জার্মানি, ইতালি, গ্রিস ও রোমানিয়া ওই এসওপি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হয়। কিন্তু বাংলাদেশি কর্মীরা মিথ্যা তথ্য, জাল ওয়ার্ক পারমিট, ভুয়া নথিপত্র, অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রাসহ একাধিক বিধি লঙ্ঘন করলে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ যাতে বৈধ অভিবাসন নীতিতে অটল থাকে এ জন্য ইতালির প্রধানমন্ত্রী চলতি আগস্টের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশ সফরে আসছেন।

ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বৃহস্পতিবার এক বার্তায় জানিয়েছে, উন্নত তথ্য মূলত উন্নত নীতিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বাংলাদেশের অভিবাসন তথ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত এক জাতীয় সংলাপে সরকার, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং সুশীল সমাজের নেতারা একত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে নির্ভরযোগ্য অভিবাসন তথ্য কীভাবে শাসনব্যবস্থাকে নিরাপদ, ন্যায্য এবং আরও কার্যকর করে তুলতে পারে তা গুরুত্ব পেয়েছে। ওই সংলাপে ইইউ বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান জুরেট স্মালস্কাইট মেরভিল জোর দিয়ে বলেন, সঠিক তথ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অভিবাসীদের আরও ভালোভাবে সুরক্ষা দিতে পারে, নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত এবং আরও সুযোগ তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে তরুণদের জন্য। ইইউ অর্থায়ন করা ডেটা প্রকল্পের মাধ্যমে ইইউ এবং বাংলাদেশ সবার জন্য অভিবাসনকে আরও স্মার্ট, নিরাপদ এবং ন্যায্য করার জন্য একসঙ্গে কাজ করছে।

Manual6 Ad Code

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবরের পর থেকে ইস্যু করা ওয়ার্ক পারমিটে কোনো স্থগিতাদেশ না থাকায় ২০২৫ সালের ফ্লুসি ডিক্রির আওতায় ওই তারিখের পরে যারা ইতালির ভিসার জন্য আবেদন করেছেন তাদের মধ্যে কয়েকশ বাংলাদেশি অভিবাসী ইতিমধ্যে ভিসা পেয়েছেন এবং আগামী মাসগুলোতে আরও অনেকে পাবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। ইতালি দূতাবাস ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে ইতিমধ্যে জনবল বৃদ্ধি করেছে। এক বা একাধিক অসাধু চক্রের মাধ্যমে জাল ওয়ার্ক পারমিট এবং নকল নথিপত্র জমা পড়ায় আবেদনগুলোর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লাগছে। ইতালিতে এ সংক্রান্ত একাধিক ফৌজদারি তদন্তও চলমান।

বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদের সভাপতি টিপু সুলতান বলেন, ‘সৌদি আরব বন্ধ, মালয়েশিয়ায় পরিস্থিতি অনিশ্চিত। নতুন গন্তব্য খুঁজে বের করা এবং সরকারি পর্যায়ে মানসম্মত গবেষণা জরুরি।’

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘ফলোআপ না করা, বেতন-ভাতা সমস্যা ও অবৈধ পথে যাত্রার ঘটনা ঘটলে এ খাতের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। নতুন গন্তব্য খুঁজতে হবে এবং দক্ষ কর্মী তৈরি ছাড়া বিকল্প নেই।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code