প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

রোহিঙ্গা সংকট: কূটনৈতিক ব্যর্থতায় নেই অগ্রগতি

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ৪, ২০২৫, ০৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ
রোহিঙ্গা সংকট: কূটনৈতিক ব্যর্থতায় নেই অগ্রগতি

Manual3 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সৃষ্টি করা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ভুগছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের পর এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গা সদস্যকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য দক্ষ ও পর্যাপ্ত কূটনৈতিক তৎপরতার অভাব রয়েছে।

 

Manual3 Ad Code

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা সংকট অনেক জটিল একটি ইস্যু। এই সংকট সমাধান করতে হলে নিজেদের প্রচুর হোমওয়ার্ক করা প্রয়োজন। প্রভাবশালী কোনো রাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই এই সংকটের সমাধান হবে না। এই সংকটের শুরুটাও হয়েছে প্রভাবশালী কোনো রাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী। কেননা আমরা তখন মানবতার কথা বলে সীমান্ত খুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু মানবতার চেয়ে দেশ বড়। আমরা নিজেদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের কথা তখন ভাবিনি। এখনও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত শতভাগ বন্ধ করা হয়নি। এই সংকট সমাধানের জন্য যে পরিমাণ হোমওয়ার্ক প্রয়োজন এবং যেমন দক্ষ কূটনীতিক এই ইস্যুতে নিয়োগ করা প্রয়োজন তা করা হয়নি। নিজেদের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই এই সংকট সমাধানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। যে কারণে গত সরকারের আমলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হয়নি এবং এই সরকারের আমলেও হচ্ছে না। আর এই সময়ে বাংলাদেশ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সামনে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। এই সময়ে নির্বাচন ছাড়া তেমন কোনো ইস্যু সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই।

 

বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতদের (আউফা) সঙ্গে মতবিনিময়ে গত বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চীনকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই অনুরোধ করেছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনেও তারা চেষ্টা করেছেন। তবে বিষয়টি একা চীনের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়, এটি চীনের সক্ষমতার বাইরে। এটি অত্যন্ত জটিল সংকট। এর সঙ্গে অনেক স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) জড়িত। আমরা যখন ২০২৩ সালে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেছি, অন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো আমাদের প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করেছে। প্রত্যাবাসন হোক, কিছু দেশ ও সংস্থা তা চায় না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব অংশীদারের ভূমিকা রাখতে হবে। চীন তার ভূমিকা পালন করবে।

 

Manual5 Ad Code

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, জাতিসংঘ সম্মেলনের সাইড লাইনে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গাবিষয়ক সম্মেলনের আগেও বলেছি এবং পরেও বলেছি যে এই ইস্যুতে নিজেদের পর্যাপ্ত হোম ওয়ার্ক না থাকলে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করলেই সংকটের সমাধান হবে না। তবে হ্যা ওই সম্মেলনের পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে তহবিল সংকট চলছিল তার কিছুটা সমাধান হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি রাষ্ট্র ওই সম্মেলনের পর আর্থিক তহবিল দিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য ওই সম্মেলনে কোনো প্রভাবশালী দেশ কিংবা কোনো জোটের শক্ত কোনো পদক্ষেপ দেখিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই সমস্যা সমাধানের কোনো পদক্ষেপ নেই।

 

প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো এখন মিয়ানমারে নির্বাচন দেখতে মরিয়া এবং তাদের নিজ নিজ স্বার্থে সেখানেই তাদের তৎপরতা চলছে। আবার মিয়ানমারে এখন অভ্যন্তরীণ সংঘাত চলছে। সেই সংঘাতেও অনেকের স্বার্থ রয়েছে। সেখানে চীনেরও স্বার্থ রয়েছে। যে কারণে অতি সম্প্রতি চীন জানিয়েছে যে, তারা এখন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সমর্থ নয়। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের এমন ভূমিকা নতুন নয়। তারা আগেও তাদের নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছিল এবং এখন তারা নিজেদের স্বার্থের কারণেই বলছে যে তাদের এখন সামর্থ্য নেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সহযোগিতা চাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আসিয়ান যদি সহযোগিতা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি মিয়ানমারের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য আসিয়ানের দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়, তবে এই সংকটের জট খুলতে পারে। তবে বাংলাদেশকে আসিয়ানের দেশগুলোকে বোঝাতে হবে যে কী কারণে তারা সহযোগিতা করবে এবং এতে তাদের কী লাভ। এ ছাড়া ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ এই বিষয়ে কিছুই করতে পারবে না।

আসিফ মুনীর আরও বলেন, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে যে রোহিঙ্গা সংকটের মতো ইস্যু ডিল করার জন্য আমাদের দক্ষ কূটনীতিক নেই। এই ইস্যুতে আমাদের নিজস্ব নীতি নেই। আমরা একবার জাতিসংঘ, একবার যুক্তরাষ্ট্র বা চীন অর্থাৎ একেকবার একেক শক্তির পেছনে ছুটছি। যে কারণে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র বা চীন বা ওআইসি ইত্যাদি এমন শক্তিগুলোর ওপর এই সংকট সমাধানের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করে লাভ নেই। আসিয়ানের দেশগুলোকে এই সংকট সমাধানে কাজে লাগাতে পারলে ফল পাওয়া যাবে। প্রবাসী রোহিঙ্গাদের একত্রিত করে তাদের দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

 

সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা সংকটটি মূলত দ্বিপক্ষীয় সংকট। বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবেই সমাধান করতে হবে। কিন্তু আমরা নিজেরা হোম ওয়ার্ক না করে অন্যদের কথামতো বিষয়টি বহুপক্ষীয় ফোরামে নিয়েছি। অন্যদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কাজ করার কারণেই এই সংকটের শুরুটাও হয়েছে। মানবাধিকার থেকে দেশ অনেক ওপরে। আমরা এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত সিল করিনি, ফলে এখনও আসা-যাওয়া আছে।

 

Manual1 Ad Code

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিজেদের হোমওয়ার্ক নেই বলেই আমরা এখনও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে প্রত্যাবাসন করতে ব্যর্থ হয়েছি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কী হচ্ছে তার কিছুই প্রকাশ্য নয়। কিন্তু যতটুকু বোঝা যায় যে প্রকৃত অর্থে সংকট সমাধানে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করলেন কিন্তু অগ্রগতি দেখিনি। চীন যেহেতু তৃতীয় পক্ষ হিসেবে এই সংকটের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাই চীনকে ওই সম্মেলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রাখা প্রয়োজন ছিল। চীন আবার এখন বলছে যে তাদের এখন সহযোগিতা করার সামর্থ্য নেই। আসলে চীন কখনোই রোহিঙ্গা ইস্যুতে সত্যিকারভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চায়নি। প্রতিবারই চীন নিজের স্বার্থে বিষয়টি দেখেছে। বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় এই সংকটকে একেকবার একেক পক্ষের পরামর্শে একেকভাবে পদক্ষেপ নেওয়ায় বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে গেছে।

 

Manual8 Ad Code

 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। ১৯৭৭-৭৮ সালে ২ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে, যার মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যায়। ১৯৯১ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে, যার মধ্যে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০১২-১৬ সালে প্রায় ৮৭ হাজার এবং ২০১৭ সালে ৭ লাখ ৫০ হাজার জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তাছাড়া ২০২৪ সালে নতুন করে আনুমানিক ৬৪ হাজার ৭১৮ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে ১৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে সাময়িকভাবে আশ্রয়ে নিয়েছেন।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code