প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

চীনের বাজারে ‘বিস্ময়কর’ ব্যর্থতা বাংলাদেশের, কারণ কী?

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ৬, ২০২৫, ০৫:১৯ অপরাহ্ণ
চীনের বাজারে ‘বিস্ময়কর’ ব্যর্থতা বাংলাদেশের, কারণ কী?

Manual4 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

প্রায় ১৪১ কোটির বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ চীন। রপ্তানিকারক যে কোনো দেশের জন্যই বড় একটি বাজার। বাংলাদেশের জন্য এখানে রয়েছে শুল্কমুক্ত ট্যারিফ সুবিধা। তারপরও বিশাল এই বাজার ধরতে পুরোপুরি ব্যর্থ বাংলাদেশ। অথচ একই সুবিধা নিয়ে দেশটিতে দারুণ ব্যবসা করছে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া।

 

চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর পার হয়েছে ইতোমধ্যে। এখন পর্যন্ত কোনো অর্থবছরেই এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পারেনি বাংলাদেশ। বর্তমানে চীনে ৯৯ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। তারপরও এমন সুযোগ কাজে লাগাতে না পারা ‘বিস্ময়কর’— মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

 

বাংলাদেশ চীনের বাজার ধরতে না পারলেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কিন্তু বেড়েছে। যা মূলত আমদানিকেন্দ্রিক। গত ১০ বছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে তিন গুণের বেশি। বাণিজ্যের ব্যবধানও বেড়েছে একই হারে। কারণ, চীন থেকে আমদানি বাড়লেও সেভাবে দেশটিতে রপ্তানি বাড়েনি বাংলাদেশের। দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশই আসে চীন থেকে। বিপরীতে মোট রপ্তানির মাত্র ১ থেকে দেড় শতাংশ যায় চীনে।

২০২২ সালে চীন তার বাজারে বাংলাদেশকে ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। বাংলাদেশ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে— বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে দুই হাজার ১১২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দেশটিতে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ রপ্তানির তুলনায় বাংলাদেশ ৩১ গুণ বেশি আমদানি করেছে চীন থেকে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ লাখ ৪৬ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ২৩২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে ওই দেশে রপ্তানি করেছে ৮ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ৭৬ কোটি ডলারের পণ্য। সেক্ষেত্রে রপ্তানির তুলনায় বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৯ ‍গুণের বেশি।

সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৪২৮ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে চীনে রপ্তানি হয়েছে ৯ হাজার ১৫১ কোটি টাকা অর্থাৎ ৭৬ কোটি ডলারের পণ্য। সেক্ষেত্রে রপ্তানির তুলনায় বাংলাদেশে এই অর্থবছরে আমদানি বেশি ছিল ৩২ ‍গুণ বেশি।

বাংলাদেশ মূলত টেক্সটাইল, পোশাক, কৃষিপণ্য (যেমন- আম, কাঁঠাল), কাঁকড়া, কুঁচিয়া ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে। পণ্যগুলোর চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধরে রাখতে না পারার কারণে রপ্তানি কমে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চীনের বিশাল বাজার ধরতে না পারার পেছনে কিছু কারণ উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে— পণ্যের মান, মূল্য এবং চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক না থাকা। শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও কিছু কিছু অশুল্ক বাধাও রপ্তানিকে প্রভাবিত করছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অশুল্কজনিত বাধা বড় বিষয় নয়। সাধারণত চীন বছরে ৩ হাজার বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। তাই আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হলে ওই পণ্যগুলোকে টার্গেট করে পরিকল্পনা করতে হবে। তৈরি পোশাক খাতে তারা বিশ্বে প্রথম স্থানে আছে। সেখানে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক। স্বাভাবিকভাবেই ওই পণ্য নিয়ে রপ্তানি বাজার ধরা কঠিন। আরেকটি বিষয়, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে বাংলাদেশে চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) এনে রপ্তানি ও সরবরাহ সক্ষমতা বৃদ্ধি করে চীনের বাজার ধরা। একই রকম শুল্ক সুবিধা নিয়ে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া ওই পথেই সাফল্য দেখিয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘চীন বিশ্বের এক নম্বর তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশেরও রপ্তানির প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক (৮৫ ভাগ)। তারপরও আমরা কিছু কিছু তৈরি পোশাক সেখানে রপ্তানি করি। তবে, সেটা করে আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান কমানো যাবে না।’

এক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনার ঘাটতি দায়ী— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চীন প্রতি বছর ৩০০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। আমাদের ওই সব পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। আমাদের যতই শুল্কমুক্ত সুবিধা দিক না কেন, তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে ওই সুবিধা কাজে আসবে না। আমাদের আগে পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন করতে হবে। সেটাই বড় বিষয়। এক্ষেত্রে চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি শূন্য শুল্কের সুবিধা নিয়ে চীনের বাজারমুখী হতে চাই, তবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সমীকরণ মিলিয়ে চীনা বিনিয়োগ নিয়ে শূন্য শুল্কের সুবিধা দেয় এমন পণ্য তৈরি করে চীনের বাজারে প্রবেশ করতে হবে। আমরা ওই সমীকরণে যেতে পারিনি। এখানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি আমরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভোক্তা কিংবা অর্থনৈতিক কল্যাণে আমদানি হতেই পারে। মূল বিষয় হলো— ওই সব দেশে কেন রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারছি না। আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করার দিকে নজর দিতে হবে। এটা শুধু চীনের জন্য প্রযোজ্য নয়, আমার তো অন্যান্য দেশ থেকেও বিনিয়োগ আসছে না।’

 

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সভাপতি মো. খোরশেদ আলম রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, ‘চীন এমন একটি দেশ, যারা প্রায় সব ধরনের পণ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর। শুধু স্বনির্ভর নয়, তাদের অনেক উদ্বৃত্তও থাকে। সেখানে উৎপাদন হয় না বা পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই। তারা প্রযুক্তি ও উৎপাদনে অনেক আধুনিক। ফলে চীনের বাজারে পণ্য রপ্তানি সহজ বিষয় নয়। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ চীন। তারা বড় আমদানিকারক দেশ নয়।’

সেক্ষেত্রে করণীয় কী— জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রপ্তানি বৃদ্ধিতে আমাদের কৌশলী হতে হবে। যেমন- পোশাক শিল্পে বিশ্বের অনেক দামি ব্র্যান্ডের পণ্য (ডেমিন, লিভাইস ইত্যাদি) বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। ওই ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিয়ে চীনে বেশি দামে বিক্রি করে। একই পণ্য আমরা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ হিসেবে প্রথমে যদি চীনে ২০-৩০টি আউটলেট দিয়ে ক্রেতাকে কোয়ালিটি সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিয়ে বিক্রি করতে পারি, তাহলে একসময় চীন কম দামে একই মানের পণ্য আমাদের থেকে নেবে। তখন একই কোয়ালিটির ওই ব্র্যান্ডের পোশাক কয়েকগুণ বেশি দামে অন্যের কাছ থেকে কিনবে না। সেক্ষেত্রে পোশাক খাতে বিপ্লব ঘটতে পারে। বর্তমানে একই পণ্য উৎপাদন করে ১ থেকে ২ ডলার লাভ করছে গার্মেন্ট-মালিকরা। তারা তখন শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে ৮ থেকে ১০ ডলার অর্থাৎ দুই থেকে তিন গুণ মুনাফা করতে পারবে। এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে চীনের বাজার ধরতে পারব আমরা। আমি বিষয়টি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও সরকারের সঙ্গে শেয়ার করেছি, কিন্তু তারা আমলে নেয়নি। এছাড়া, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি এবং চীন থেকে কাঙ্ক্ষিত এফডিআই না আসায় রপ্তানি বাড়ছে না।”

Manual3 Ad Code

 

চীনা পণ্যের দাপট বাংলাদেশে

বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পণ্য আমদানির উৎস হিসেবে একসময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দের দেশ ছিল ভারত। এক যুগ আগে তা পাল্টে গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে চীনা পণ্যের দাপট চলছে বাংলাদেশের বাজারে। এখনো তা বজায় আছে। অর্থাৎ পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দের দেশ এখন চীন। এরপর ভারতের অবস্থান।

বিগত কয়েক দশকের আমদানির কিছু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ১১ কোটি ডলারের পণ্য আসে চীন থেকে। সেখানে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে আসে প্রায় ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয় প্রায় ৩৮২ কোটি ডলারের পণ্য। এভাবে চলতে চলতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে চীন থেকে আসে ১ হাজার ৫৫৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য।

 

কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হলে পণ্য আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে যায়। ওই বছর চীন থেকে আমদানি হয় ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ডলারের পণ্য। তবে, কোভিড একটু দুর্বল হয়ে এলে চীন থেকে ব্যাপকভাবে বাড়ে পণ্য আমদানি। ২০২১-২২ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয় ২ হাজার ৪২৫ কোটি ডলারের পণ্য।

চীন থেকে বাংলাদেশে ৫ হাজারের বেশি ধরনের পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। যার মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি, তৈরি পোশাকের বিভিন্ন কাঁচামাল, প্লাস্টিক পণ্য, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, প্রায় সব ধরনের তুলা, লোহা ও ইস্পাত, রাবার সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র, কমলা জাতীয় ফল, কাগজ ও কাগজের বোর্ড, অস্ত্র ও গোলাবারুদের যন্ত্রাংশ, সৌর প্যানেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও ব্যাটারি রয়েছে।

চীনা পণ্যের আমদানি বৃদ্ধির বিষয়ে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে চীনা পণ্য আমদানির অধিকাংশই বেসরকারি খাতের মাধ্যমে হয়। আমদানি বেশি হচ্ছে, এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ভোক্তা কিংবা অর্থনৈতিক কল্যাণে বেশি আমদানি হতেই পারে। আগে অন্যান্য দেশ থেকে হতো। এখন চীনা পণ্য দাম ও মান হিসাবে তুলনামূলক সস্তায় পাওয়া যায়। সেই কারণে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, মূল বিষয় হলো ওই সব দেশে কেন রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারছি না। আসলে আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করার দিকে নজর দিতে হবে। এটা শুধু চীনের জন্য প্রযোজ্য নয়, আমার তো অন্যান্য দেশ থেকেও বিনিয়োগ আসছে না।’

 

অন্যদিকে, চীনে ৬০০ থেকে ৭০০ ধরনের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। যার মধ্যে রয়েছে- চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, সুতা, কাঁকড়া, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, শাকসবজি, টেক্সটাইল কাপড়, আসবাবপত্র, কৃষিপণ্য, চা, রাসায়নিক পণ্য, কাঁচা পাট, পাটের পণ্য, নিটওয়্যার, টি-শার্ট, তৈরি পোশাক, মানুষের চুল ও লেডিস পণ্য ইত্যাদি।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নেতাদের মতে, চীনে রপ্তানি বাড়াতে গেলে দেশটি যে ধরনের পণ্য চায়, সেই ধরনের পণ্য প্রস্তুত করতে হবে। কোভিড-১৯-এর পর কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রপ্তানি অনেক কমেছে। আগে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান এ দুটি পণ্য রপ্তানি করত, এখন করে ১৬টি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া, কম দামের টি-শার্ট ও ট্রাউজার রপ্তানিরও ভালো বাজার আছে চীনে। চামড়ার জন্যও চীন একটি ভালো গন্তব্যস্থল।

 

Manual8 Ad Code

কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ফিশারিজ খাতকে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়ার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমাদের অনেক জলাভূমি রয়েছে। যেমন- পূর্বাচলের জলসিঁড়িতে বিশাল লেক রয়েছে। ওটা আমি চীনাদের লিজ দিতে চাই। কারণ, চীনা প্রযুক্তিতে চাষে মাছ দ্রুত বর্ধনশীল হয়। তবে, সরকারের পলিসিগত সহায়তা দরকার। তারা যদি এটা করে দেয়, তাহলে আমাদের নদী-খালে মাছ চাষেও বিপ্লব হতে পারে। রপ্তানির অন্যতম পণ্য হতে পারে এই মাছ। আমাদের ‍কৃষিজমির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, আমাদের জমি ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত। ফলে এখান থেকে বাণিজ্যিক সাফল্য পাওয়া কঠিন। তবে, আম-কাঁঠাল জাতীয় ফল বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।’

 

পণ্য রপ্তানিতে অশুল্ক জটিলতা

ট্যারিফ কমিশনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য থেকে রাজস্ব আয় করছে মূলত আমদানি-নির্ভর শুল্ক থেকে। তাই চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হলে শুল্ক কমে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। কারণ, চীনের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্য খুবই সীমিত। বিপরীতে আমদানি অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকলেও চীনের বন্দর ও প্রবেশ-সংক্রান্ত কিছু জটিলতা রপ্তানি বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে।

গবেষণা অনুসারে, অশুল্ক বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে- চীনা পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা তার অনুমোদিত সংস্থার মাধ্যমে নিবন্ধন করার শর্ত। আমদানি কিংবা রপ্তানিতে বন্দরে প্রবেশের ১৪ দিনের মধ্যে কাস্টমস বিভাগে ঘোষণা দিতে হয়। এর সঙ্গে আমদানি বা রপ্তানি চুক্তি, চালান, বিল অব লেডিং, প্রতিনিধি দ্বারা ঘোষণা করা হলে তার অনুমোদনপত্র, রপ্তানির অনুমোদনপত্র এবং প্রক্রিয়াজাত বাণিজ্য হ্যান্ডবুক ইত্যাদি যুক্ত থাকতে হয়। এ সময় রপ্তানিকারককে কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও গুণগত তত্ত্বাবধান, পরিদর্শন ও কোয়ারেন্টাইনের শর্তও পূরণ করতে হয়। প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় ছোট ও মাঝারি রপ্তানিকারকরা চীনা বাজারে প্রবেশে নিরুৎসাহিত হয়ে থাকেন।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধে লাভ হবে বাংলাদেশের?

অন্যদিকে, জাতীয় নিরাপত্তা, উচ্চমূল্যের বা জটিল প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্রপাতি, নির্দিষ্ট উচ্চতা বা আয়তনের সরঞ্জাম, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত কঠিন বর্জ্য এবং জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক পণ্যের ক্ষেত্রে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) বাধ্যতামূলক। ফলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য অতিরিক্ত খরচ ও সময়ের চাপ তৈরি হয়।

চীনে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য দপ্তরের মাধ্যমে কিছু পণ্য নিয়ন্ত্রিত রয়েছে। যেমন- গম, ভুট্টা, চাল, চিনি, তামাক, অপরিশোধিত তেল ও প্রক্রিয়াজাত তেল, রাসায়নিক সার ও তুলা। এসব পণ্যের রপ্তানি অনুমোদন পেতে কোটা বা বিশেষ লাইসেন্স প্রয়োজন হয়।

খাদ্যপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন খাদ্য নিরাপত্তা মান বজায় রাখে যাতে সবজিতে বিষাক্ত কীটনাশকের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেজন্য পণ্য রপ্তানিতে ফিট সার্টিফিকেট, ভালো বীজের সার্টিফিকেট, গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস, কীটনাশকমুক্ত কৃষিপণ্য, জৈব (অর্গানিক) পণ্য, খাদ্য গুণমান সার্টিফিকেট ও হ্যাজার্ড অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কন্ট্রোল পয়েন্ট ব্যবস্থাপনা সিস্টেম ইত্যাদি বিষয় রয়েছে। এভাবে মান বজায় রাখতে বাংলাদেশের কৃষক ও প্রসেসরদের পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। ফলে আমাদের কৃষিপণ্য (যেমন- আম, কাঁঠাল, শাকসবজি) দেশটিতে সহজে প্রবেশ করতে পারে না।

চীনে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্যের লেবেল অবশ্যই চীনা ভাষায় থাকতে হয়। এতে পণ্যের নাম ও ট্রেডমার্ক, প্রকার, উৎপাদনকারীর নাম ও ঠিকানা, উৎপত্তিস্থল, ব্যবহার নির্দেশিকা, ব্যাচ নম্বর ও প্রাসঙ্গিক মান কোড উল্লেখ থাকতে হয়। খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উপাদানসমূহ (ওজন বা আয়তনের ক্রম), নেট ওজন, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ করতে হয়। বিষয়গুলো অনেকে উপেক্ষা করায় পণ্য বন্দরেই আটকে যায় বা ফেরত পাঠানো হয়।

চীনা সরকার সাধারণত দেশীয় পণ্য, প্রকল্প ও সেবা ক্রয় করে থাকে। বিদেশি সরবরাহকারীর কাছ থেকে ক্রয় কেবল তখনই অনুমোদিত হয়, যখন স্থানীয় বাজারে পণ্যটি অপ্রাপ্য বা অনুপযুক্ত দামে পাওয়া যায়। এ ধরনের আমদানি ক্রয়ের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

চীন সাধারণ আমদানি করা পণ্যগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে। সেগুলো হলো- অনুমোদিত, নিয়ন্ত্রিত ও নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশিরভাগ পণ্য অনুমোদিত শ্রেণিতে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় লাইসেন্স প্রযোজ্য হয়। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কাস্টম প্রশাসন যৌথভাবে বছরভিত্তিক পণ্য আমদানির তালিকা করে লাইসেন্স ইস্যু করে। নিয়ন্ত্রিত পণ্যগুলো নন-অটোমেটিক লাইসেন্স বা কোটার আওতায় থাকে। জননিরাপত্তা, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের কারণে এটি সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জননীতি, প্রাণী-উদ্ভিদ সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিশোধ ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির কারণে চীন নির্দিষ্ট পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করে থাকে। ফলে চাইলেও রপ্তানি পণ্য সহজে বাজারে প্রবেশ করতে পারে না।

এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের সদস্য পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, চীনের অশুল্ক বাধাগুলো শুধু প্রশাসনিক নয়। এগুলো অনেক সময় সুরক্ষামূলক প্রকৃতির হয়। যার মাধ্যমে তারা নিজেদের কৃষি ও শিল্পকে রক্ষা করে। চীনের বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার শুল্কমুক্ত হলেও কার্যত অশুল্ক বাধার দেয়াল অতিক্রম করা কম চ্যালেঞ্জ নয়। এসব অশুল্ক বাধা শনাক্তকরণ এবং প্রক্রিয়া সহজ করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা জরুরি।

তবে, অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, রপ্তানিতে চীনের অশুল্ক বাধা তেমন নেই। রুলস অব অরিজিনও তেমন সমস্যা সৃষ্টি করে না। একই রকম ধারণা দিয়েছেন বিসিসিসিআই সভাপতি মো. খোরশেদ আলম। তিনিও অশুল্ক শর্ত বড় ইস্যু হিসেবে মনে করছেন না।

 

বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের চিত্র

চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশে খুব বেশি নয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, বিগত নয় বছরে বাংলাদেশে চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট ২ হাজার ৯২৬ দশমিক ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন এবং সর্বনিম্ন ২০১৪ সালে ৩৭ দশমিক ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও ২০১৯ সাল থেকে বিনিয়োগ আবার কমতে শুরু করে। যা কমতে কমতে ২০২২ সালে ৫২৫.৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৩৭.২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৫ সালে ৫৬.৭৯ মিলিয়ন ডলার, ২০১৬ সালে ৬১.৪০ মিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে ৯০.১২ মিলিয়ন ডলার, ২০১৮ সালে ১০২৯.৯০ মিলিয়ন ডলার, ২০১৯ সালে ৬২৫.৯২ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে ৯১.৩৩ মিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে ৪০৭.৮৮ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২২ সালে ছিল ৫২৫.৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 

ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার সাফল্যের রহস্য কী?

ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াও বাংলাদেশের মতো চীনের শুল্ক সুবিধা ভোগ করছে। তারা চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রপাতি ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে সফল হয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি এখনও প্রধানত পোশাকের ওপর নির্ভরশীল, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। অর্থাৎ পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আমদানি-রপ্তানির বড় বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ট্রেডিং ইকোনোমিক্সের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে ভিয়েতনাম চীনে রপ্তানি করেছিল প্রায় ৬০.৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য; যার মধ্যে ৩১.৬৪ বিলিয়ন ডলার ছিল ইলেকট্রনিক্স পণ্য। ভিয়েতনাম কাস্টমসের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে ভিয়েতনাম চীনসহ বিশ্বব্যাপী কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স কম্পোনেন্টসের আমদানি প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। চীন থেকে কম্পোনেন্ট বা কাঁচামাল আমদানি করে নিজ দেশে মান ও উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি-উপযোগী পণ্য তৈরি করছে তারা। এ কারণে ভিয়েতনামের জন্য চীন শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা নিয়ে বৃহৎ উৎপাদন ও রপ্তানির প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত করেছে।

Manual7 Ad Code

এদিকে, চায়না ডেইলির তথ্যানুসারে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত কম্বোডিয়া চীনে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে সাফল্য দেখিয়েছে। ওই সময়ে প্রায় ২.৪ মিলিয়ন টন কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছে দেশটি। কম্বোডিয়ার গণমাধ্যম বলছে, ২০২৪ সালে চীনের সঙ্গে কম্বোডিয়ার মোট বাণিজ্য দাঁড়ায় প্রায় ১৫.১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে কম্বোডিয়া থেকে চীনে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশটি চীনের বাজারে তাজা ফল, শুকনো ক্যাসাভা, শুকনো আমগুঁড়া, রাবার ইত্যাদি রপ্তানিতে সাফল্য দেখিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে দেশ দুটো প্রমাণ করেছে শুধু শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকলেই হয় না; উৎপাদন সক্ষমতা, গুণগত মান, সার্টিফিকেশন, লজিস্টিক সাপোর্ট ও দ্বি-পাক্ষিক ব্যবসায়িক যোগাযোগও জরুরি।

এ প্রসঙ্গে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, ভিয়েতনাম গত অর্থবছরে প্রায় ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। তার মধ্যে চীনেই করেছে এক তৃতীয়াংশ। তাদের অধিকাংশই চীনের এফডিআই। সেখানে আমাদের ২ বিলিয়ন ডলারও আসেনি। আমাদের কেন হচ্ছে না, সেটাই বড় প্রশ্ন!’

‘আমরা অনেক চেষ্টা করলাম, চট্টগ্রামের আনোয়ারাতে চীনের জন্য স্পেশাল জোন করার। ওটাকে উদ্দেশ্য করে টানেল করলাম। ওই টানেলের রক্ষণাবেক্ষণের খরচও ওঠে না। কারণ, চীনের যে বিনিয়োগ আসার কথা ছিল, সেটা আসেনি। এসব জায়গায় আমাদের ফোকাস দিতে হবে। কেন হলো না, সেটাও দেখার বিষয়। আমি মনে করি, বিনিয়োগ আকর্ষণ ছাড়া বাণিজ্য ব্যবধান কমানো সম্ভব নয়।’

বাংলাদেশের সমস্যা আরও বৃহত্তর পরিসরের— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বেশি, ইনফ্রাস্ট্রাকচার বটলনেক নেই, আমার সিঙ্গেল উইনডো নেই, লজিস্টিক পলিসি বাস্তবায়ন করতে পারি না এবং পোর্টে টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বেশি। এসব বিষয়ে আমাদের অ্যাড্রেস করতে হবে। তাহলে আমি এফডিআই-নির্ভর রপ্তানি ও সরবরাহ সক্ষমতা বৃদ্ধি করে চীনের বাজার ধরতে পারব। অনেক সম্ভাবনা আমাদের রয়েছে।’

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি খোরশেদ আলমও ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার রপ্তানি বৃদ্ধির পেছনে বিনিয়োগ আসার বিষয়টি সাফল্য হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া এগিয়ে গেছে। কারণ, ওই সব দেশের শিল্পের অধিকাংশ কারখানার মালিক হন চীনের নাগরিক, অথবা সেগুলো যৌথ মালিকানার। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চীনের বিনিয়োগ। সে কারণে পণ্য রপ্তানিতে তারা এগিয়ে গেছে। এরূপ বিনিয়োগ চীনের মহাপরিকল্পনার অংশ। কারণ, চীন ধরে নিয়েছে ভবিষ্যতে হয়তো ইউরোপ কিংবা ন্যাটোভুক্ত দেশ চীন থেকে সরাসরি পণ্য নাও নিতে পারে। তখন যাতে পরোক্ষভাবে চীনা পণ্যের রপ্তানি অব্যাহত থাকে সেজন্যই তারা ওই সব দেশে বিনিয়োগ করছে। এক্ষেত্রে আমাদেরও ওই সুযোগ রয়েছে। তবে, তারা তো এমনি এমনি আসবে না।’

বেশকিছু পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক খোরশেদ আলম আরও বলেন, ‘আমাদের পলিটেকনিক্যাল পড়াশোনায় জোর দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। যেমন- বাংলাদেশের অন্তত ২০টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট তাদের মালিকানায় কিংবা দেখভালের দায়িত্ব চীনা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিতে হবে। তাহলে দেশটির শিক্ষক আমার দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নত প্রযুক্তিজ্ঞানসহ হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি চীনের বাজারের উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে ওঠার পাশাপাশি চীনের বাজার সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাবে। ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে।’

‘বর্তমানে অনেক টেক্সটাইল কারখানা বন্ধ রয়েছে। আমরা আলোচনা করে চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারি কিংবা যৌথ মালিকানায় সেগুলো চালু করতে পারি। তাহলে আমাদের কারখানাগুলো সফলভাবে চালুর পাশাপাশি দেশটির বাজার ধরতে পারবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে— বাংলাদেশে অন্তত দুটি চীনা ব্যাংক করার অনুমতি দিতে হবে। তাহলে এলসি চীনা মুদ্রায় হবে। আমার খরচ কমে যাবে। কারণ, বর্তমানে এলসি ওপেন হয় ডলারে, সেখানে আবার কমিশন বাণিজ্য চলে। কিন্তু চীনা মুদ্রায় যখন লেনদেন হবে তখন খরচ এমনিতেই কমে যাবে। চীনা বিনিয়োগকারীরাও স্বস্তিতে এই দেশে বিনিয়োগ করবে। অন্যদিকে, ডলারের নির্ভরশীলতাও কমে যাবে। আবার শেয়ার বাজারে চীনা বিনিয়োগের সুযোগও তৈরি করা যেতে পারে।

 

Manual5 Ad Code

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগের কী অবস্থা?

চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকার চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৮০০ একর জমিতে একটি চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য একটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৬ সালে এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশনের মধ্যে ২০২২ সালে একটি চুক্তিও হয়। চলতি বছর প্রকল্পটি দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সহায়ক অবকাঠামোসহ প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৪ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট হিসেবে চীনের সরকার থেকে আসার কথা। প্রকল্প ব্যয়ের বাকি ১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা ১ শতাংশ সুদে সরকার থেকে অর্থায়নের প্রস্তাব রয়েছে বেজার।

এ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণ এবং জেটি থেকে সিইপিজেডকে সংযুক্ত করে সড়ক নির্মাণ, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারসহ (সিইটিপি) প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। ২০২৯ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুসারে, কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না প্রকল্পটি।

 

এছাড়া, চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য চাঁদপুর জেলায় জিটুজি ভিত্তিতে আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ভোলা জেলায় একটি চীনা কোম্পানির জন্য আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

বাংলাদেশের চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের বিষয়ে সিপিডির অপর সম্মাননীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ এলে কর্ণফুলী টানেল অর্থনৈতিকভাবে উপযোগী হবে। এছাড়া, বিনিয়োগের ফলে বাংলাদেশ ও চীনের সহযোগিতাও বৃদ্ধি পাবে। চীনের অর্থায়নে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক চমৎকার। আমাদের দেখতে হবে, এ সম্পর্ক থেকে আমরা ভালো কিছু কীভাবে বের করে আনতে পারি। তবে, প্রতিটি ভালো সম্পর্কেরই নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। আমাদের আমদানির এক-চতুর্থাংশ চীন থেকে আসে। এখানে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে চীন আমাদের ঋণ দিতে পারে। এতে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে চাপ কম পড়বে।

দেশে চীনা বিনিয়োগ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘চীন-বাংলাদেশ শিল্প ও সরবরাহ চেইন সহযোগিতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ৩ দশমিক ৭ গুণ বেড়েছে। গত আগস্ট থেকে প্রায় ২০টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশি অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। এসব চুক্তির সম্ভাব্য মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গঠনে প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা জরুরি। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও চীন যৌথভাবে কাজ করবে। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) দ্রুত আলোচনার টেবিলে আনার আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত ওয়েন।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code