প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বিনিয়োগ থমকে যাওয়ায় উদ্বেগ

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ৯, ২০২৫, ০৩:১৬ অপরাহ্ণ
বিনিয়োগ থমকে যাওয়ায় উদ্বেগ

Manual6 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual4 Ad Code

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে ধীরগতি, অনেক খাতেই অচলাবস্থা। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রয়েছে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এই পরিস্থিতিতে দেশ বিনিয়োগ খরায় পড়েছে। নতুন বিনিয়োগ রীতিমতো থমকে আছে। বিনিয়োগ থমকে থাকায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশের শিল্পোদ্যাক্তারা একরকম হাত গুটিয়ে রেখেছেন। তারা পর্যবেক্ষণ করছেন, দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি কোন দিকে মোড় নেয়। একই সঙ্গে উদ্যোক্তারা অপেক্ষায় আছেন কবে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং একটি স্থিতিশীল সরকার আসবে।

এদিকে বিনিয়োগ থমকে থাকায় বাড়ছে না কর্মসংস্থান। উল্টো একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। বিজিএমইএর তথ্য মতে, গত এক বছরে শুধু তৈরি পোশাক কারখানাই বন্ধ হয়েছে ২৫৮টি। বেকার হয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক। এই পরিস্থিতিতে দেশের ব্যবসয়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘ দিন ধরে বিনিয়োগ খরা ও কর্মসংস্থান না বাড়ার ফলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে যেমন পড়বে, তেমনি বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় দেখা দেবে সামাজিক সংকট। সুতরাং বিনিয়োগ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটানো দরকার।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এমনিতে দেশের অর্থনীতির একটি-দুটি সূচক ছাড়া অধিকাংশ সূচকের অবস্থা ভালো না। একরকম মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি। আছে অর্থের টানাটানি। এই পরিস্থিতিতে যদি দীর্ঘদিন বিনিয়োগ থমকে থাকে তা হলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। বিনিয়োগ না বাড়ায় নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে না। এতে দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। এভাবে যদি বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকে তা হলে দেশে সামাজিক সংকট দেখা দেবে। তাই দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারকে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, আমরা যারা উদ্যোক্তা তারা নিজেদের চলমান কারখানাগুলোই ঠিকমতো চালাতে পারছি না, সেখানে নতুন করে কারখানা গড়ার কথা তো স্বপ্নেও ভাবতেই পারছেন না। নানা রকম সংকটে প্রায় প্রতিদিনই বন্ধ হচ্ছে কোনো না কোনো শিল্প কারখানা, বেকার হচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিক। এই অবস্থার মধ্যে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন কীভাবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা যারা উদ্যোক্তা তারাসহ পুরো দেশের মানুষ এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। আমরা বুঝতে পারছি না দেশ আগামীতে কোন দিকে যাবে। গত দেড়টা বছরও কেটেছে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে, এখনও আমরা অনিশ্চয়তায়। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে জাতীয় নির্বাচান অনুষ্ঠিত হবে, অথচ এখনও প্রতিদিন সবার মনে একই প্রশ্নÑনির্বাচন হবে তো ফেব্রুয়ারিতে। আমরা চরম আস্থার সংকটে আছি। নির্বাচন আদৌ কি হবে, না দেশে অন্য কিছু ঘটবে তা আমরা কেউই বলতে পারছি না। এই রকম অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে কোন উদ্যোক্তা তার কষ্টের টাকা বিনিয়োগ করবে? কেউই এখন বিনিয়োগের ঝুকি নেবেন না। মূলত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে রেখেছেন। আমরা চায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এবং দেশে একটা স্থিতিশীল সরকার আসুক। যতদিন সেটি না হবে ততদিন বিনিয়োগও বাড়বে না।

Manual8 Ad Code

দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না কমছে সেটি অনেকটাই বোঝা যায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে না বাড়ছে বা ঋণপত্র খোলা বাড়ছে না কমছে তার দিকে তাকালেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবরে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশের বেশি কমেছে। এটি অর্থনীতিতে আমদানির চাহিদা হ্রাস এবং নতুন বিনিয়োগে স্থবিরতার প্রতিফলন। ২০২৫ সালের অক্টোবরে ৫.৬৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের একই মাসে ছিল ৬.৪২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এলসি খোলার হার কমেছে ১২.১৫ শতাংশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৬.৩১ বিলিয়ন ডলার। এলসি নিষ্পত্তির হারও আগের বছরের তুলনায় ১১.৪৮ শতাংশ কমেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে এলসি বিল পরিশোধ করা হয়েছিল ৬.১০ বিলিয়ন ডলারে, যা এ বছরের অক্টোবরে কমে ৫.৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে নিট ইক্যুইটি (নতুন বিনিয়োগ) দাঁড়িয়েছে ৮১ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের একই প্রান্তিকে ছিল ২১৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ৬২ শতাংশ কম। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ৬.২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বেসরকারি খাতের ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। নতুন বিনিয়োগ কমলে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে।

Manual6 Ad Code

 

এদিকে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির সমর্থিত অনেক ব্যবসায়ী পালিয়ে গেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মামলায় আটক হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন অনেক শীর্ষ ব্যবসায়ী। পাশাপাশি শেখ হাসিনার পরিবারসহ ১১টি শিল্প গ্রুপ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ফলে তাদের ব্যবসার গতি ধীর হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদ বদলে দেওয়ার ১৫টি ব্যাংকঋণ কার্যক্রমও কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একীভূত হতে যাওয়া ৫ ব্যাংকঋণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছু শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে তাই ব্যবসা-বাণিজ্য গতি হারিয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমে গেছে।

এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে একটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এই নীতির আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহারে। ফলে বাজারে ঋণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণগ্রহণে মন্থর গতি লক্ষ করা যাচ্ছে। উচ্চ সুদের বোঝা বহন করতে না পেরে অনেক উদ্যোক্তা নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এতে শিল্প, ব্যবসা ও উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা বিবেচনায় নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন করে ঋণ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যার ফলে গত আগস্ট মাসেও দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে। ওই মাসে এই প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৩৫ শতাংশে, যা গত জুলাইয়ে ছিল ৬.৫২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৩ সালের পর এটাই সবচেয়ে কম ঋণ প্রবৃদ্ধি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা জুলাই মাসের ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার নামমাত্র পর্যায়ে নেমে এসেছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৬.৮২ শতাংশে নেমেছিল, যা তখনও ছিল নিম্নতম স্তর। তবে আগস্টে তা আরও কমে নতুন রেকর্ড গড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরেও প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.২৮ শতাংশ, জানুয়ারিতে কমে ৭.১৫ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৬.৮২ শতাংশে নেমে আসে। পরে মে মাসে সামান্য বেড়ে ৭.১৭ শতাংশে দাঁড়ালেও আবার ধীরগতি ফিরে আসে আগস্টে।

 

এ ছাড়া করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সময়েও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশের নিচে নামেনি। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির থাকলেও সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে বাজারে টাকার প্রবাহ বজায় রেখেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে এমন কোনো প্রণোদনা নেই, বরং অর্থনীতিতে কঠোরতা বাড়ছে। ২০২১ সালের মে মাসে প্রবৃদ্ধি একবার ৭.৫৫ শতাংশে নেমেছিল, কিন্তু পরের মাসেই আবার বেড়ে ৮.৩৫ শতাংশে উঠে আসে। এবার এমন কোনো পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি মুদ্রানীতির কারণে বিনিয়োগ চাহিদা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ বিতরণে আগ্রহ হারাচ্ছে, আবার উদ্যোক্তারাও নতুন বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চান না।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার পরিবর্তনের পর ব্যবসায়িক পরিবেশে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তা বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। দেশের অনেক প্রভাবশালী উদ্যোক্তা ও বড় ঋণগ্রহীতা বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন, কেউ কেউ বিদেশে অবস্থান করছেন। ফলে বাজারে নতুন প্রকল্পে ঋণের চাহিদা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।

Manual7 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code