প্রজন্ম ডেস্ক:
হঠাৎ করেই বাজারে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ৪০ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। এই ঘটনায় সরকার কিছুটা বিব্রত। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার নীরব বলে অভিযোগ রয়েছে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা বাড়লেও তা জানে না কেউ। ব্যবসায়ীদের গতানুগতিক বক্তব্য- ‘সরবরাহ কম।’ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, এ বছর পেঁয়াজের মৌসুম প্রায় শেষ। চলতি নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নতুন পেঁয়াজের পাতা বাজারে উঠতে শুরু করবে। ডিসেম্বরে আসবে ‘মুড়িকাটা পেঁয়াজ’। জানুয়ারিতে সিজনের নতুন পেঁয়াজে বাজার সয়লাব হবে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের কাছে এই মুহূর্তে যে পরিমাণ পেঁয়াজ আছে তা দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব। কিন্তু হাতে থাকা পেঁয়াজ কয়েক দিন ধরে রেখে, বাজারে সংকটের গুজব ছড়িয়ে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে শেষ কামড় দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। যে যেভাবে পারছেন সিজনের শেষ মুনাফাটা লুটে নিচ্ছেন।
সূত্র জানিয়েছে, দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির করে তুলেছে একটি সুযোগসন্ধানী সিন্ডিকেট। বছরের শেষ সময়ে এসে মজুত কমে যায় ঠিকই, কিন্তু এ বছর পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হওয়ায় সে সংকটও নেই। কৃষক নয়, মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে পেঁয়াজের মজুত রয়েছে। যা দিয়ে বছরের শেষ এক মাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। অথচ চক্রটি প্রতিবছরই এই কৃত্রিম সংকট তৈরির কাজটি করে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এই কারণেই এ বছরও অনৈতিক মুনাফার আশায় পেঁয়াজের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে তারা। সরকারের পক্ষ থেকে বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে সাধারণ মানুষ কৃষকের পরিশ্রমের ফসল বাম্পার উৎপাদনের সুফল পাচ্ছেন না।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ চেইন ঠিক না থাকায় মজুত সংকটে পড়েছে পেঁয়াজের বাজার। অন্যান্য বছর পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও চলতি বছর আমদানি করা হয়নি। তারা বলছেন, আমদানিতে বাধা পড়ায় পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।
এ বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ী রহমত আলী বলেন, ‘দাম ঠিক কী কারণে বেড়েছে জানি না। আমরা বেশি দাম দিয়ে এনেছি, তাই বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম বাড়ার পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের কোনও হাত নেই। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনি, সেই অনুযায়ী কিছুটা মুনাফা নিয়ে আমরা বিক্রি করি। আমরা নিজেরাও জানি না কেন এভাবে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।’
কাওরান বাজারের আড়তদার সোহরাব হোসেন বলেন, ‘এ বছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ টন। আমদানি করা পেঁয়াজের কোনও দরকার ছিল না। তবে টানা বৃষ্টিতে প্রায় দুই লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। এ কারণেই পেঁয়াজের বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে।’
তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, কৃষি মন্ত্রণালয় ভুল পরিসংখ্যানে আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ভোক্তার চাহিদা ও জোগানের হিসাবে গরমিল থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর ৫-৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কিন্তু এবার তা হয়নি। এছাড়া দেশে উৎপাদন বাড়লেও পরবর্তী সংরক্ষণ বা আমদানি-আবশ্যকতা ঠিকমতো পূরণ হয়নি বলে উৎপাদনের প্রায় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ স্টোরেজ করতে না পারায় নষ্ট হয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করছেন।
অন্যদিকে আড়তদারদের মতে, কিছু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে পেঁয়াজ ধরে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে কিছু পেঁয়াজ নষ্টও হয়েছে, ফলে সরবরাহ কমেছে। এ কারণেই সব স্তরে দামে প্রভাব পড়েছে। তাদের ধারণা, এই অবস্থা কয়েক সপ্তাহ চলতে পারে। তবে নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বা আমদানি করে পেঁয়াজ বাজারে ছাড়লেই দাম কমে যাবে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য অনুযায়ী, এক মাসে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ। তবে তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখনও ২২ শতাংশ কম। রাজধানীর মালিবাগ, কাওরান বাজার ও আগারগাঁওয়ে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। কয়েক দিন আগেও দাম ছিল ৮০ টাকা। অর্থাৎ কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
আমদানিকারক ও বড় পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে দৈনিক পেঁয়াজের চাহিদা ৬ থেকে ৭ হাজার টন। কিন্তু বর্তমান সরবরাহে সেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। নতুন মৌসুমের মুড়িকাটা পেঁয়াজ এখন কৃষকের ক্ষেতে। এখন চাষির ঘরে কোনও পেঁয়াজ নেই। নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে আরও এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে। তাই তারা মনে করছেন, এখন আমদানির বিকল্প নেই।
তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশে এখনও পেঁয়াজের প্রকৃত সংকট হয়নি। বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ থাকলেও একটি মহল পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে এবং আমদানির অনুমতি আদায়ের চেষ্টা করছে।
অপরদিকে সুযোগসন্ধানী সিন্ডিকেটের সদস্যদের খুঁজে বের করতে মাঠে নামানো হচ্ছে সরকারের চারটি গোয়েন্দা সংস্থাকে। বর্তমানে পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ এই চার জেলায় অন্তত সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ মজুত রয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ইতোমধ্যে এসব জেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে একটি সূত্র।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার তদারকির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত শুক্রবার প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে মানভেদে ১১০ থেকে ১২০ টাকা। শনিবারও তা বিক্রি হয়েছে একই দামে। এক সপ্তাহ আগে ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।
এদিকে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। নতুন পেঁয়াজের পাতা ও মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসতে শুরু করবে বাজারে। তবে পেঁয়াজ মজুতদারদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে পাবনার পেঁয়াজ চাষি মো. শাহীন মিয়া বলেন, ‘বৃষ্টিতে কিছুটা সমস্যা হয়েছে ঠিকই, তবে ফলন ভালো হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ছোট ছোট পেঁয়াজসহ পেঁয়াজের পাতা বাজারে সরবরাহ করতে পারবো। তখন পুরান পেঁয়াজের ওপর থেকে চাপ কমবে। নভেম্বর মাস শেষেই মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসবে।’
ফরিদপুরের চাষি আসলাম উদ্দিন জানিয়েছেন, পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারসাজি না হলে সংকট হওয়ার কথা নয়। এখনও পুরোনো পেঁয়াজের মজুত রয়েছে। সরকারের তদারকিতে এসব পেয়াজ বাজারে আনা গেলে সংকট থাকবে না। দামও কমবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ বছর দেশে প্রায় ৩০ থেকে ৩৭ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব হবে। যেহেতু এটি পচনশীল পণ্য, সেহেতু উৎপাদিত পেঁয়াজ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হবে। তারপরও ২৮ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ করা যাবে।
এদিকে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভুল সিদ্ধান্তই সংকটের জন্য দায়ী। প্রতিবছর ভারত থেকে ৫-৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হতো। এ বছর কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি হয়েছে। আমদানি লাগবে না। ফলে আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বাজারে পেঁয়াজের সংকট আছে। জানুয়ারি নাগাদ পুরোদমে আসবে মুড়িকাটা পেঁয়াজ। তার আগ পর্যন্ত সংকট থাকতে পারে। তবে পেঁয়াজের পাতাসহ ছোট ছোট পেঁয়াজ আসবে এক দেড় সপ্তাহের মধ্যে। তখন কিছুটা চাপ কমবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের নজরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্বিগ্ন। প্রশাসন মাঠের চিত্র খতিয়ে দেখছে। প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।’
Sharing is caring!