প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

হিট অফিসারের ‘সুপারহিট’ স্বামী

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২১, ২০২৪, ০৫:৩১ পূর্বাহ্ণ
হিট অফিসারের ‘সুপারহিট’ স্বামী

Manual1 Ad Code

স্টাফ রিপোর্টার:
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের জামাতা আহমেদ জাওয়াদ রায়হান ওরফে রাবি। তিনি ডিএনসিসির আলোচিত হিট অফিসার বুশরা আফরিনের স্বামী। শ্বশুরের ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে তিনি প্রথমে তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করেন। তারপর ভাড়ায় নেওয়া বাসায়ই গড়ে তোলেন সিসা বার।

এক পর্যায়ে বাড়ির মালিককে হুমকিতে তটস্থ রেখে দখল করে নেন। সরেজমিন অনুসন্ধানেও ঘটনার সত্যতা মিলেছে।

অভিযোগ রয়েছে, আবাসিক হিসেবে ভাড়া চুক্তি করে রেস্তোরাঁ বানানোয় বাড়ি ছাড়তে নোটিশ দেন বাড়ির মালিক মুর্তজা রেজা। গত ২০ সেপ্টেম্বর সেখানে গেলে হুমকি-ধমকি দেন সিন্ডিকেটের সদ্যসরা।

এতে বাধ্য হয়ে ৩১ অক্টোবর গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ভুক্তভোগী মুর্তজা রেজা। কিন্তু অদৃশ্য কারণে পুলিশও নিষ্ক্রিয় বলে দাবি করেছেন তিনি। যদিও পুলিশ বলছে, এরই মধ্যে অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গুলশান-১ সার্কেলের ১১২ নম্বর সড়কের ২১/এ প্লটের ৮.৩৭ কাঠা জমির মালিক মুর্তজা রেজা।

প্রবাসী মুর্তজা রেজা সিঙ্গাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করায় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে অটোমোবাইল ব্যবসায়ী রায়হান আজাদ টিটোর সঙ্গে আবাসিক ভাড়া চুক্তি করেন। রায়হান আজাদ টিটোর স্ত্রী ছিলেন আফরোজা রায়হান ওরফে আফরোজা বিনতে এনায়েত সোমা। মাসিক এক লাখ টাকা ভাড়ায় এক বছরের জন্য চুক্তি করে উভয় পক্ষ। দ্বিতল বাড়িটিতে কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়া শুধু বসবাসের জন্য ভাড়া দেন বাড়ির মালিক মুর্তজা রেজা। একই সঙ্গে এক মাসের নোটিশে বাড়ি ছাড়ার শর্তও ছিল চুক্তিপত্রে।

Manual8 Ad Code

কিন্তু ২০২০ সালে চুক্তি নবায়নের সময় শর্ত ভঙ্গের প্রশ্ন তোলেন মুর্তজা রেজা। আফরোজা রায়হানের সঙ্গে চুক্তির আগে তিনি রেস্তোরাঁ সরিয়ে নেওয়ার মৌখিক শর্ত দেন। ওই সময় সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের মেয়ে আলোচিত চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের স্বামী আহমেদ জাওয়াদ রায়হান ওরফে রাবি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মুর্তজা রেজাকে চুক্তি করতে চাপ দেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে আবাসিক ভাড়া চুক্তি করেন মুর্তজা রেজা। ওই সময় রেস্তোরাঁ সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেন তাঁরা। কিন্তু রেস্তোরাঁ না সরিয়ে তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের শরণাপন্ন হন বুশরা আফরিনের স্বামী আহমেদ জাওয়াদ। গড়ে ওঠে হারুন-জাওয়াদের নতুন সিন্ডিকেট। আগে রেস্তোরাঁ থাকলেও এবার নতুন করে যোগ হয় সিসা লাউঞ্জ। এদিকে মুর্তজা রেজার দাবি, তিনি রেস্তোরাঁর আড়ালে সিসা বার বন্ধে বহুবার চাপ দিলেও বিভিন্নভাবে হেনস্তা শুরু করে হারুন-জাওয়াদ সিন্ডিকেট। এখনো অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে বাড়িটি। ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ‘ডিবি হারুন যুগের’ অবসান ঘটলেও বীরদর্পে চলছে তাঁর সিন্ডিকেটের গড়া সিসা বারটি।

Manual7 Ad Code

অনুসন্ধানে গণমাধ্যমের হাতে আসে মুর্তজা রেজা ও আফরোজা রায়হানের মধ্যকার চুক্তিপত্র। চুক্তিপত্রে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন আহমেদ জাওয়াদ রায়হান রাবি। চুক্তিপত্রে জাওয়াদ রায়হানের পিতার নাম ও ঠিকানা যথাক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে মৃত মাহবুবুর রহমান, ফ্ল্যাট বি-৪, ৫, বাড়ি নং : ৩/১২, ব্লক সি, লালমাটিয়া ঢাকা-১২০৭; যা সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে বুশরা আফরিনের স্বামীর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী মুর্তজা রেজা বলেন, ‘আমার মা-বাবার মৃত্যুর পর বাড়িটি খালি পড়ে ছিল। আমি একজন বিশ্বাসযোগ্য ভাড়াটিয়া খুঁজছিলাম, যিনি বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণও করবেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমি প্রথমে রায়হান আজাদ টিটো এবং পরে তাঁর স্ত্রী আফরোজা রায়হানের সঙ্গে আবাসিক ভাড়া চুক্তি করি। প্রথম বছর তাঁরা ভালোই ছিলেন, কিন্তু আতিকুল মেয়র নির্বাচিত হলে তাঁর মেয়ের জামাই আহমেদ জাওয়াদ রায়হানের ছত্রচ্ছায়ায় আফরোজা আমার বাড়ি দখল করে নেন। আহমেদ জাওয়াদও এই সিসা বারের অংশীদার বলে আমি জেনেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমি ২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিই, কিন্তু তাঁরা বাড়ি না ছেড়ে বিভিন্ন উপায়ে আমাকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। আমাকে দেখে নেবেন বলে শাসাচ্ছেন।’

জানা যায়, গত ৩১ অক্টোবর গুলশান থানায় জিডি করেন ভুক্তভোগী মুর্তজা রেজা। জিডিতে বলা হয়, ‘২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভাড়াটিয়াকে আমি বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিই। পাশাপাশি ৩০ জুন ২০২৪ চুক্তি শেষ হওয়ার পরেও আফরোজা রায়হান বাড়িটি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। এরপর গত ২০ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টায় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিতে চাই। কিন্তু আফরোজা রায়হান আমাকে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করেন।’

এ প্রসঙ্গে জিডির তদন্ত কর্মকর্তা রাজু আহমেদ বলেন, ‘মুর্তজা রেজার জিডিটি আমরা পেয়েছি। অনুসন্ধানের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুমতি পেলে আমি অনুসন্ধান শুরু করব।’

সরেজমিনে গত ১২ নভেম্বর দ্য কোর্টইয়ার্ড বাজার রেস্টুরেন্টে যান এই প্রতিবেদক। ১১২ নম্বর রোডের দ্বিতীয় প্লটটিতে গড়ে উঠেছে দ্য কোর্টইয়ার্ড বাজার। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা মিলল খোলা একটি জায়গা, যেখানে অতিথিরা গাড়ি পার্ক করে। পার্কিং এরিয়া অতিক্রম করতেই নিয়ন বাতিতে সজ্জিত রেস্তোরাঁর জন্য রয়েছে আরো একটি প্রবেশদ্বার। খোলা আকাশের নিচে অতিথিদের জন্য সজ্জিত রয়েছে একধিক চেয়ার-টেবিল। রেস্তোরাঁর মূল ফটকের পাশেই পিঠা উৎসবের জন্য একটি স্টল রয়েছে।

Manual8 Ad Code

সারি সারি চেয়ার-টেবিলে এরই মধ্যে একাধিক অতিথিও এসেছে। কিন্তু দ্বিতল ভবনের মূল ফটকে সবুজ কাপড় দিয়ে পৃথক জোন তৈরি করা হয়েছে। দ্য কোর্টইয়ার্ড বাজারের লবিতে থাকা রেস্তোরাঁয় একটি টেবিলে চোখ আটকে গেল। ২২ থেকে ২৩ বছর বয়সী এক যুবক সিসা সেবন করছেন। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী, সিসাকে মাদকদ্রব্যের ‘খ’ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এরই মধ্যে রেস্তোরাঁয় থাকা অন্য টেবিলগুলোতেও অতিথির আগমন হয়। বেশির ভাগ গ্রাহক শুধু সিসা সেবনের জন্যই এসেছে রেস্তোরাঁয়। সিসার পাশাপাশি হালকা খাবারও অর্ডার করছে কেউ কেউ।

Manual2 Ad Code

এ সময় এই প্রতিবেদকের কথা হয় রেস্তোরাঁটির খাবার পরিবেশকের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রিমিয়াম ও সাধারণ ক্যাটাগরিতে ৩ ফ্লেভারের সিসা সেবনের ব্যবস্থা রয়েছে, যার দাম সর্বনিম্ন এক হাজার ৭০০ এবং সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা। এ সময় ওই পরিবেশকের নাম জানতে চাইলে তিনি অসম্মতি জানান।

পরিচয় গোপন করে সবুজ কাপড় দিয়ে ঢাকা রেস্তোরাঁটির মূল ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে সেখানকার কর্মীদের বাধার মুখে পড়তে হয়। তাঁরা জানান, এটি সংরক্ষিত এলাকা। নির্দিষ্ট অতিথিরাই এখানে প্রবেশ করতে পারবে। আশাহত হয়ে এই প্রতিবেদক ফিরে আসেন লবিতে থাকা রেস্তোরাঁয়। সেখানে দেখা যায়, ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক তরুণ-তরুণী সিসা সেবন করছেন। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে কোনো ব্যক্তি সিসা সেবন, বহন, বিক্রি ও সরবরাহ করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। এক কেজি অথবা লিটার বা তার কম হলে অনূর্ধ্ব এক বছর থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড, এক কেজি অথবা লিটারের বেশি এবং পাঁচ কেজি বা লিটারের কম হলে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড এবং পরিমাণ পাঁচ কেজি বা লিটারের বেশি হলে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

দ্য কোর্টইয়ার্ড বাজার রেস্তোরাঁর পাশেই সরকারি কর্মকর্তাদের ছয়তলা ভবন সুরমা। কোর্টইয়ার্ড থেকে বের হয়েই দেখা হয় সুরমা ভবনের এক বাসিন্দার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সরকারের অনুমোদন ছাড়া আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কোর্টইয়ার্ড সরকারি নির্দেশনা অতিক্রম করে এখানে সিসা বার গড়ে তোলে। রাত ২টা পর্যন্ত রেস্তোরাঁর কার্যক্রম চলে। অনেক সময় হৈ-হুল্লোড় হয়। ফলে বাসিন্দাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

তিনি বলেন, সিসা বারে যারা নিয়মিত যাতায়াত করে তাদের মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবাসিক এলাকায় এই রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠায় উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. মেহেদী হাসানকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code