
প্রজন্ম ডেস্ক:
ভারতের মাধ্যমে পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাপে পড়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় দেশ থেকে আকাশপথে পণ্য রপ্তানি বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বিমানবন্দরে ল্যান্ডিং, পার্কিং ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ কমানোর সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার মান বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন বিমান উপদেষ্টা।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার এই সুপারিশপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কার্গো পরিচালনা সহজ ও সাশ্রয়ী করতে চার্জ কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে বেবিচক। এখন মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষা।
অন্যদিকে বুধবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের প্যাসেঞ্জার ও কার্গো গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সভা করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। সভায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার মান বাড়াতে এবং এভিয়েশন খাতকে লাভজনক করতে সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন উপদেষ্টারা।
২০২০ সালের ২৯ জুন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল যে ট্রান্সশিপমেন্ট প্রক্রিয়ায় ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো যাবে।
অর্থাৎ পণ্য পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ ভারতের সমুদ্রবন্দর বা বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারবে।
এর পর থেকে বাংলাদেশের গার্মেন্টসসহ নানা পণ্য ভারতীয় বিমানবন্দর দিয়ে আকাশপথে রপ্তানি হতো, কিন্তু ভারত সম্প্রতি হঠাৎ এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। এতে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। সংকট নিরসনে সরকার নতুন করে কার্গো অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার হযরত শাহজালালসহ তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেন কার্গো সেবা বৃদ্ধি করা যায় এবং সেবার মান বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয় বেবিচক। এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া বলেন, ‘কার্গো চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে বিমান ও বেবিচক যৌথভাবে চার্জ পুনর্বিন্যাসের কাজ করছে। বেবিচক চার্জ কমানোর প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এখন তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। আশা করছি শিগগিরই খরচ কমানোর ঘোষণা আসবে।’
এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। এ ছাড়া সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এপ্রিল থেকে পূর্ণাঙ্গ কার্গো কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়েও শিগগিরই কার্গো অপারেশন চালুর প্রক্রিয়া চলছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল চালুর আগে আমাদের অবকাঠামো তিন গুণ সক্ষমতায় প্রস্তুত করা হচ্ছে। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনাল জাতীয় কার্গো সক্ষমতায় ইতোমধ্যেই বড় অবদান রাখছে। আমরা আশা করছি, দ্রুতই কার্গো সেবার সক্ষমতা বাড়ানো যাবে।’
শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এ বছরের শেষ নাগাদ চালু হলে দেশের বার্ষিক কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ২ লাখ টন থেকে বেড়ে ৫ লাখ ৪৬ হাজার টনে উন্নীত হবে। আধুনিক অটোমেশনসহ ৩৬ হাজার বর্গমিটারের আলাদা কার্গো জোন থাকবে সেখানে। বিমানবন্দরটির কার্গো ভিলেজ দৈনিক ৩০০ টন ধারণক্ষমতার জন্য নির্মিত হলেও বর্তমানে পিক টাইমে প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ টনেরও বেশি কার্গো হ্যান্ডলিং করে। এখন প্রতি কেজি কার্গোতে চার্জ প্রায় শূন্য দশমিক ২৯ ইউএস ডলার, যা দিল্লির তুলনায় প্রায় ছয় গুণ বেশি। এ ছাড়া ঢাকায় জেট ফুয়েলের দামও ভারতের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। তবে সম্প্রতি কিছুটা কমেছে জেট ফুয়েলের দাম। অন্যদিকে বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে যেন কার্গো সেবা নিতে কম খরচ পড়ে বা তার থেকে বেশি না হয়, তেমন প্রতিযোগিতামূলক মূল্যই নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই রপ্তানিকারকরা হযরত শাহজালালে কার্গো পরিবহনের উচ্চ খরচ ও অদক্ষ লজিস্টিক ব্যবস্থার কারণে অসন্তুষ্ট। এ বিষয়ে টাওয়ার ফ্রেইট লজিস্টিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েসনের (বাফা) ভাইস প্রেসিডেন্ট নুরুল আমিন বলেন, ‘আগে বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে পণ্য রপ্তানি করলে পরিবহন ব্যয় কম লাগত। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি রপ্তানি করলে খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়। তাই এ বিষয়ে আমরা বরাবরই সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছি, যেন খরচটা কমানো হয়। দেশের কার্গো সুবিধা নিতে খরচ কমানো, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস ভালো করা এবং সময়মতো গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস পাওয়া নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।’
অন্যদিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংকট এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এই সুযোগে বাংলাদেশ নিজস্ব সক্ষমতায় একটি আঞ্চলিক কার্গো হাব হিসেবে গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতের এমন সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে, যদি আমরা আমাদের কার্গো সেবা বাড়াতে পারি। বিশেষ করে চার্জ কমানো অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে চার্জ যদি পাশের দেশগুলোর চেয়ে কম চার্জ নেওয়া যায়, তাহলে নেপাল-ভুটানও আমাদের বিমানবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী হবে। ফলে এটি একটি হাবে পরিণত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে কার্গো সেবা দেওয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের কাজগুলোও ভালোভাবে করতে হবে। যেমন- গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এবং পণ্য স্ক্যানিংয়ে দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। যেন পণ্যের জট না হয়। এ ছাড়া দেশের মধ্যে রপ্তাণি পণ্য পরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী করতে হবে। তা না হলে দেশের সবগুলো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যে কার্গো সেবা চালু করা হচ্ছে, তা সুফল পাবে না।’
Sharing is caring!