
প্রজন্ম ডেস্ক:
নজিরবিহীন মাত্রায় পৌঁছেছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে কাঁপছে তেহরান এবং তেল আবিব। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে বাড়ছে মরদেহ আর ধ্বংসের স্তূপ। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে চিরবৈরী দেশ দুটির সংঘাত। ইরানের প্রায় ৮০০ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে ইসরায়েল। টানা আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ইরানও থেমে থেমে জবাব দিয়ে চলেছে। ট্রু প্রমিস থ্রি অভিযানের মাধ্যমে দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখে পড়ছে তেল আবিব। উভয় পক্ষই সামরিক ও জ্বালানি স্থাপনা লক্ষ্য করে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরানে এরই মধ্যে শতাধিক মৃত্যু হয়েছে বলে খবর মিলেছে। ইসরায়েল অন্তত ১১ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। ইসরাইলের হাইফা ও ইরানের ইসফাহানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও জ্বালানি অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।
ইরান বলছে, ইসরায়েল আক্রমণ করা বন্ধ করলেই তারা থেমে যাবে।
আর যুদ্ধবাজ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ইরানকে চরম মূল্য দিতে হবে। আর বিশ্বমোড়ল সাজা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, তিনি নাকি সহজেই যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারেন।
ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে তিনি আশা করেছেন, শিগগিরই ইরান-ইসরাইল চুক্তি হবে। জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য অবিলম্বে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে চাইছে।
রোববার (১৫ জুন) ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তেহরানে অন্তত ৮০টি লক্ষ্যবস্তুতে রাতভর হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলায় ডজনখানেক ইসরাইলি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে টানা তৃতীয় দিনে এ হামলা চালানো হলো।
বিবিসির খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে ছিল ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর, সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা বলে দাবি করা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক সামরিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল দুটি ‘দ্বৈত-ব্যবহারের’ জ্বালানি কেন্দ্র। ওই জ্বালানি কেন্দ্র সামরিক ও পারমাণবিক কাজে ব্যবহার করা হতো।
আইডিএফ আরও জানিয়েছে, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর অংশ হিসেবে তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে তারা ইরানের ১৭০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ইরানের ৭২০টির মতো সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে। ইসরায়েলের হামলায় নিহত ও আহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু- এমনটাই জানিয়েছেন ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ রেজা জাফরঘান্দ।
তাকে উদ্ধৃত করেছে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, তিন দিন ধরে চলা সংঘর্ষে ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। তবে শুক্রবার জাতিসংঘে ইরানের দূত জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের প্রথম দফা হামলায় অন্তত ৭৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর পরদিন রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, একটি আবাসিক ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ৬০ জন নিহত হন।
অন্যদিকে ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো অন্তত ১১ জন ইসরায়েলি নিহত এবং দুই শতাধিক আহতের কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশ সময় রোববার রাত ৮টার দিকে ইসরায়েলে মিসাইল ছুড়ে তৃতীয় দফায় জবাব দেয় ইরান। নতুন দফার এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দখলকৃত অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শহর- তেল আবিব, আশকেলন ও হাইফাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
হিব্রু ভাষার গণমাধ্যমগুলো জানায়, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হাইফা ও টিবেরিয়াস শহরেও আঘাত হেনেছে।
খবরে আরও বলা হয়, ইসরাইলের অধিকৃত সব অঞ্চলেই সাইরেন বেজে ওঠে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) শনিবার রাতে ইসরায়েলি আগ্রাসনের জবাবে আরেক দফা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এটি ছিল প্রতিশোধমূলক সামরিক অভিযান ‘ট্রু প্রমিস থ্রি’-এর দ্বিতীয় পর্যায়। যার প্রথম দফা শুরু হয় শুক্রবার। এই নজিরবিহীন প্রতিশোধমূলক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে ‘ইয়া আলি ইবনে আবি তালিব’ সাংকেতিক নামে। যা ঈদুল গাদিরের পবিত্র দিনের সঙ্গে মিলিয়ে শুরু করা হয়েছে। শনিবার স্থানীয় সময় মধ্যরাতে ইরানের নতুন দফার হামলা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছে।
আইআরজিসি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার জবাবে তাদের মহাকাশ বিভাগ নতুন করে এই ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পর্ব শুরু করেছে। এই দফার মূল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েল অধিকৃত বন্দর শহর হাইফা এবং তার আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও শিল্প স্থাপনা।
হাইফার তেল শোধনাগারে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার পর বিশাল অগ্নিকাণ্ড ঘটে। রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা গেছে, তেল শোধনাগারে অগ্নিকাণ্ড থেকে ঘন কালো ধোঁয়া উঠছে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান ছড়িয়ে পড়তে পারে। হাইফায় অবস্থিত তেল শোধনাগারে থাকা পাইপলাইন ও বিদ্যুৎ পরিবহন লাইন ধ্বংস হয়েছে। এই তথ্য জানা গেছে তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদন থেকে।
রয়টার্স জানায়, কিছু নিম্নস্তরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও শোধনাগারের প্রধান অংশ এখনও সচল রয়েছে।
ইরানের মিসাইল নিক্ষেপের খবরে উত্তর ইসরায়েলের গালিল অঞ্চল, নাজারেথ শহর, আফুলা এবং পশ্চিম গালিলেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় সতর্কতা সাইরেন বেজে ওঠে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উচ্চ নির্ভুলতার সঙ্গে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে এবং ইসরাইলের বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে ব্যাপক অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। ফলে কেন্দ্রীয় ও উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
কয়েকটি হিব্রু ভাষার সংবাদমাধ্যম জানায়, হাইফায় অবস্থিত অ্যামোনিয়া ট্যাংকেও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করে। তাতে করে বিভিন্ন স্থানে আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। অনেক সংবাদমাধ্যম মধ্যরাতের ওই হামলাকে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে ইসরায়েলের ওপর পরিচালিত ‘সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
হামলার আগে ইরানি সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলি সামরিক পাইলটদের হুঁশিয়ার করে যে, ‘নিজের জীবন রক্ষা করুন। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’ তাদের আহ্বান ছিল-পাইলটরা যেন গোলা না ছুড়ে নিরাপদে বিমান নামিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, ইরান এই দফায় হাইফা ও তেল আবিবে হামলার জন্য এমাদ, কাদর এবং খাইবার শেকান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।
রাতভর ইরানি হামলার পরের সকালকে ‘অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও কঠিন’ বলে মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
হারজোগ বলেন, ‘ইরানের এই অপরাধমূলক হামলায় ইহুদি ও আরব, ইসরায়েলি নাগরিক ও নতুন অভিবাসী- শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে- নিহত ও আহত হয়েছেন।’ ইরানের হামলায় বিধ্বস্ত ইসরায়েলের বাত ইয়াম শহরের একটি স্থান পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার জন্য ইরানকে খুবই চড়া মূল্য দিতে হবে। ইরান থেমে থেমে জবাব দিলেও থেমে নেই যুদ্ধবাজ ইসরায়েল। তেহরানজুড়ে দিনভর বিকট বিস্ফোরণের শব্দ।
তেহরানের বাসিন্দারা সিএনএনকে জানিয়েছেন, রোববার বিকালে শহরে আবারও কয়েকটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ অনুভূত হয়েছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, শহরের পশ্চিমাঞ্চলের একাধিক আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠতে দেখা গেছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি গাড়ি আগুনে পুড়ছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত মাত্রা বা কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কি না, তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি।
বিস্ফোরণের খবর আসার সময়ই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানায়, ইরানে আরও হামলা চলছে। আইডিএফের মুখপাত্র এফি ডেফরিন বাংলাদেশ সময় রোববার রাতে বলেন, আমরা এক মুহূর্তের জন্যও হামলা বন্ধ করছি না। এই মুহূর্তেও তেহরানে আমরা বিভিন্ন নতুন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছি।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আরবিভাষী মুখপাত্র অ্যাভিচাই আদরিই এক বিবৃতিতে দাবি করেন, ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের ইসফাহানে একটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। তার মতে, এই হামলায় ইউরেনিয়াম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ সংক্রান্ত অবকাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ইরান সরকার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এর আগে ইরানের তেল মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ইসফাহানে অবস্থিত একটি তেল শোধনাগারের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে সচল ও স্বাভাবিক রয়েছে। দেশটির আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা আইএসএনএ এই তথ্য দিয়েছিল।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলে ইরানও হামলা থামাবে। গত শুক্রবার ইসরায়েলের হামলার পর এই প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে এলেন আরাগচি। তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলা সাম্প্রতিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। ইরান যদি আমাদের ওপর যেকোনো ধরনের, যেকোনো উপায়ে হামলা করে, তা হলে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী এমন তৎপরতা চালাবে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে, আমরা সহজেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চুক্তি করতে পারি এবং এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারি।’ মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি শান্ত করতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে অবিলম্বে দেশটির সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইওহান ভাদেফুল এ কথা বলেছেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য সফরে ওমানে রয়েছেন ভাদেফুল। ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।
জার্মানির সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘এআরডি’কে ভাদেফুল বলেন, ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করছে জার্মানি।
Sharing is caring!