প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

শেখ হাসিনাকে নিয়ে দিল্লির কেন এত গোপনীয়তা?

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ৩, ২০২৪, ০২:২২ অপরাহ্ণ
শেখ হাসিনাকে নিয়ে দিল্লির কেন এত গোপনীয়তা?

Manual3 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

বাংলাদেশের ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়ে চরম নাটকীয় পরিস্থিতিতে ভারতে পদার্পণ করেন শেখ হাসিনা– এর পর প্রায় তিন মাস হতে চললো। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, শেখ হাসিনাকে আপাতত এ দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে– শুধু এটুকু ‘কনফার্ম’ করা ছাড়া ভারত সরকার তাকে নিয়ে আজ পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি।

মানে শেখ হাসিনাকে কোথায় বা কীভাবে রাখা হয়েছে, তা নিয়ে আজ পর্যন্ত ভারত সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও বক্তব্য নেই। তার ইমিগ্রেশন ‘স্ট্যাটাস’ বা কীসের ভিত্তিতে তিনি ভারতে আছেন, তা নিয়েও দিল্লি যাবতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছে।

গত তিন মাসে শেখ হাসিনাকে নিয়ে সব প্রশ্নেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাঁধাধরা জবাব ছিল, ‘আপনারা জানেন খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে তাকে এ দেশে সাময়িকভাবে চলে আসতে হয়েছিল। তিনি এখনও সেভাবেই আছেন।’ শুধু একবার মুখপাত্র বলেছিলেন, তাকে ‘সুরক্ষার কারণে’ ভারতে চলে আসতে হয়।

শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল তাকে বাংলাদেশের ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বলেও একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। যা থেকে স্পষ্ট, ভারতের চোখেও তিনি এখন আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও ৬ আগস্ট বিকালে দেশের পার্লামেন্টে বলেছিলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে’ প্রধানমন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়েই শেখ হাসিনা ভারতে এসেছেন।

Manual4 Ad Code

কিন্তু তিনি যদি প্রধানমন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়েও থাকেন, সেটা কীভাবে দিয়েছেন বা সেই প্রক্রিয়ার বৈধতা কতটা, তা নিয়েও ভারত সরকার তাদের অবস্থান একবারের জন্যও স্পষ্ট করেনি।

সোজা কথায়, শেখ হাসিনাকে ঘিরে পুরো বিষয়টাতেই ভারত সরকার চরম গোপনীয়তা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর প্রায় তিন মাস ধরে সেটা বজায় রাখতে সফলও হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো– এটা কেন করা হচ্ছে? কেন ভারতে তার উপস্থিতি নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করা হচ্ছে না?

Manual4 Ad Code

শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া, তা সে সাময়িকই হোক বা দীর্ঘকালীন, সেই সিদ্ধান্ত যে একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর আজকের যুগে এরকম একজন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিকে গোপনে আশ্রয় দেওয়া সম্ভবও নয়– ভারতে সেটা করতেও যায়নি। প্রথম সুযোগেই তাকে আশ্রয় দেওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকেই পুরো ইস্যুটাতে এক ধরনের ‘কঠিন নীরবতা’ বজায় রাখা হয়েছে।

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে দিল্লিতে তিন জন সাবেক কূটনীতিবিদ বা পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা হয়। এ বিষয়ে তাদের মতামত তাদের বয়ানেই তুলে ধরা হলো।

 

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী

 

তিনি বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রোটোকল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান। তিনি বলেন, ‘আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন শেখ হাসিনাকে নিয়ে এত আঁটোসাঁটো গোপনীয়তা কেন, তার সহজ উত্তর হবে নিরাপত্তা।’

শেখ হাসিনা ভারতের জন্য এমন একজন বিশেষ অতিথি, যার জীবন ও নিরাপত্তা নিয়ে এতটুকু ঝুঁকি নেওয়ার কোনও অবকাশ নেই। ভারত তাকে তার এই বিপদের মুহূর্তে শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, সেই সঙ্গে তার সুরক্ষারও দায়িত্ব নিয়েছে– এটাও কিন্তু মনে রাখতে হবে।

 

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ভারতে শেখ হাসিনার জীবনের ঝুঁকি কোথায়? এর উত্তরে বলতে হবে, অনেক দিক থেকেই ঝুঁকি থাকতে পারে। বাংলাদেশে যেসব ‘জিহাদি’ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অতীতে তার সরকার কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে, তাদের সদস্যরা যে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শেখ হাসিনার জীবননাশের চেষ্টা চালাবে না, তা কে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে? শেখ হাসিনার ‘লোকেশন’ যদি পাবলিক ডোমেইনে থাকে, তাহলে তার ডেরায় গিয়ে চারটে বোমা ফেলার চেষ্টা যে হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?

বিশেষত কিছু দিন আগেই আমরা দেখেছি বাংলাদেশে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রেহমানির মতো জেলবন্দিরাও এখন জামিন পেয়ে বাইরে চলে এসেছেন। এতে তো এসব গোষ্ঠীর লোকজন নিশ্চিতভাবেই উৎসাহিত বোধ করবে। এ পরিস্থিতিতে তারা কী করতে চাইবে কিছুই বলা যায় না। ফলে ভারত যে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, তার কারণ বোঝা মোটেও শক্ত নয়!’

 

শুভ্রকমল দত্ত

 

ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ ফরেন পলিসি এক্সপার্ট শুভ্রকমল দত্ত। তিনি বলছিলেন, ‘দেখুন, কেন ভারত শেখ হাসিনার এ দেশে থাকা নিয়ে কিছু বলতে চাইছে না– তার একাধিক কারণ আছে বলে আমি মনে করি।’

 

প্রথমত, যে আন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে তার পেছনে আমেরিকা যে কলকাঠি নেড়েছে তা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। যত দিন যাচ্ছে নানা ঘটনায় সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে। এখন এই আমেরিকা কিন্তু আরও নানা বিষয়ে ভারতের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক মিত্র, স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার এবং একসঙ্গে তারা কোয়াড জোটেরও সদস্য। এবং আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে পর্দার আড়ালে অবশ্যই কথাবার্তা চলছে। ভারতও নিশ্চয়ই তাদের মতো করে সংকট সমাধানের ফর্মুলা খুঁজছে। তার মধ্যে সে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও আর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই, যাতে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার গতিবিধি বা ভারতে তার অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করে দিল্লি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে চাইবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। বরং তারা অপেক্ষা করে দেখবে, আমেরিকার রাজনৈতিক গতিপথ কোনদিকে যায়।

দ্বিতীয় কারণটা অবশ্যই শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সুরক্ষা বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত। ভারতের নীতি এক্ষেত্রে খুব পরিষ্কার, যতদিন তিনি এ দেশে থাকছেন কিংবা স্বেচ্ছায় তৃতীয় কোনও দেশে যাচ্ছেন না, ততদিন তাকে সসম্মানে ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে অতিথি হিসেবে রাখা হবে। এ কারণেই তাকে ‘জেড প্লাস প্লাস’ বা তারও বেশি ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দিয়ে খুব গোপন কোনও স্থানে রাখা হয়েছে। এ ধরনের ভিভিআইপিদের মুভমেন্ট নিয়ে কোনও তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হয় না, এখানেও ঠিক সেটাই করা হয়েছে। তাই আমার মতে, ভারতের এই সিদ্ধান্ত শতকরা একশো ভাগ যুক্তিসঙ্গত।

 

ভাস্বতী মুখার্জি

Manual5 Ad Code

 

তিনি ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ, নেদারল্যান্ডস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিযুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারত যে প্রকাশ্যে কিছু বলছে না তার প্রধান কারণ হলো পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বিচারিতা।’

Manual1 Ad Code

 

কেন আমি এই কথাটা বলছি? কারণ সারা দুনিয়া জানে এই আমেরিকাই পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে ওসামা বিন লাদেনকে খতম করে এসেছে। অথচ তারাই আবার ভারতের দিকে আঙুল তুলে বলতে চাইছে, আমরা নাকি তাদের দেশে থাকা খালিস্তানি নেতাদের হত্যা করতে চাইছি! এই অভিযোগের সারবত্তা হয়তো এতটুকুও নেই। কিন্তু আমেরিকার চোখে নিরাপত্তার মাপকাঠি যে তাদের নিজেদের বেলায় একরকম, আর বিশ্বের অন্যদের বেলায় আরেক রকম– তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না!

এখন শেখ হাসিনাকে যেহেতু ভারতই আশ্রয় দিয়েছে, তার নিরাপত্তার বিষয়টাও না হয় ভারতকেই সামলাতে দিন! ভারত তো এখন আর ঔপনিবেশিক শাসনে নেই, তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা আর অধিকার দুটোই আছে।

ফলে শেখ হাসিনার উপস্থিতি নিয়ে কতটুকু বলা হবে আর কতটুকু বলা হবে না, সেটাও পুরোপুরি ভারতেরই এখতিয়ার। কূটনৈতিক বা স্ট্র্যাটেজিক, সব দিক বিবেচনা করেই ভারত যে সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাতে আমার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই, যুক্ত করেন তিনি।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code