প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বড় দুই বাজারে রফতানিতে চমক: চীনের ঘাটতি পূরণ করছে বাংলাদেশ

editor
প্রকাশিত এপ্রিল ২৭, ২০২৫, ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ
বড় দুই বাজারে রফতানিতে চমক: চীনের ঘাটতি পূরণ করছে বাংলাদেশ

Manual1 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আবারও দারুণ গতি পেয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬.৯৯ শতাংশ বেড়ে ৩.৬৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আগের বছর এই অঙ্ক ছিল মাত্র ২.৬৯ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে ইইউ’র বাজারে মোট পোশাক আমদানি বেড়েছে ১৭.৮১ শতাংশ (মূল্য অনুযায়ী), এবং পরিমাণে বেড়েছে ২৮.৬৬ শতাংশ। ইউরোস্টাটের বরাতে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এসব তথ্য জানিয়েছে।

বিজিএমইএ বলছে, আমদানি প্রবৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি— যা বাংলাদেশের বাজার দখলের সক্ষমতা স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের বাজার শেয়ার কমার ফলে তৈরি হওয়া শূন্যস্থান দখলে বাংলাদেশ সফল হয়েছে।

 

ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র: দুই বাজারেই বাংলাদেশের অগ্রগতি

Manual6 Ad Code

 

একদিকে ইউরোপে রফতানিতে দারুণ সাফল্য এসেছে, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশের পোশাক রফেতানিতে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি নিয়ে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তারপরও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ১৭.২৩ শতাংশ, রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫.৭৪ বিলিয়ন ডলার।

বিজিএমইএ’র তথ্যমতে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় একক গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। মোট রফতানির ১৮.৯৭ শতাংশই সেখানে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মন্দা ও কিছু সুরক্ষাবাদী-নীতির মধ্যেও এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশি পোশাক শিল্পের টেকসই প্রতিযোগিতাশক্তির প্রমাণ দিচ্ছে।

 

সাফল্যের পেছনে কী রয়েছে?

 

বিশ্লেষক ও উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে একাধিক শক্ত ভিত। এগুলো হলো— উচ্চমানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন। পরিবেশবান্ধব কারখানা (গ্রিন ফ্যাক্টরি)। সামাজিক ও শ্রমিক নিরাপত্তায় অগ্রগতি। দ্রুত ডেলিভারি সক্ষমতা। ইইউতে জিএসপি সুবিধা তথা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘বাংলাদেশের কারখানাগুলো এখন বিশ্বমানের। ক্রেতারা এখানে নির্ভরতার জায়গা খুঁজে পান।’ তিনি আরও বলেন, ‘মূল্য সংযোজিত পোশাক উৎপাদন, ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার এবং শ্রমিক-উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আবারও শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে।’

 

দামে সামান্য হ্রাস, পরিমাণে বড় অগ্রগতি

এই প্রবৃদ্ধি যতটা না দামে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণনির্ভর। ইইউ বাজারে ইউনিট দামে গড়ে ১.৪৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, অথচ পরিমাণগত প্রবৃদ্ধি ৩৯.০২ শতাংশ। এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ ক্রেতাদের চাহিদামতো সাশ্রয়ী দামে পণ্য সরবরাহ করছে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

 

চীন পিছিয়েছে, বাংলাদেশ এগিয়েছে

ইইউ’র বাজারে চলতি সময়ে চীনের রফতানি বেড়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ, যা দাঁড়িয়েছে ৪.৫৪ বিলিয়ন ডলারে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩৭ শতাংশ, যা স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে নির্দেশ করে। তুরস্কের রফতানি কমেছে ৩.৬৪ শতাংশ। ভারত, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া ২১-২২ শতাংশ হারে বাড়লেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রেও চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য কমছে। ২০১৮ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রফতানি ছিল বাংলাদেশের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি, ২০২৪ সালে সেই ব্যবধান কমে এসেছে মাত্র দুই গুণে। বাংলাদেশের রফতানি দাঁড়িয়েছে ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলারে এবং চীনের কমে ১৬.৫০ বিলিয়ন ডলারে।

 

বড়দিনের মৌসুম ঘিরে ব্যস্ততা, রয়েছে শঙ্কাও

যুক্তরাষ্ট্রে বড়দিনের বাজার ঘিরে বাংলাদেশের কারখানাগুলো ইতোমধ্যে নতুন অর্ডার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ পেয়েছেন বাংলাদেশের পোশাক সরবরাহকারীরা। ফলে চলতি বছরের শেষভাগ, বিশেষ করে বড়দিনের মৌসুম পর্যন্ত কারখানাগুলো ব্যস্ত সময় পার করবে। তবে আশঙ্কা রয়েছে— এসব চালান ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কের আওতায় পড়তে পারে।

Manual2 Ad Code

পোশাক প্রস্তুতকারীরা জানান, বড়দিন উপলক্ষে উৎপাদনের কাজ আসন্ন জুন থেকে পুরোদমে শুরু হবে এবং তা জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত চলবে। আগস্ট থেকে রফতানি শুরু হয়ে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মার্কিন বাজারে এসব পণ্য বিক্রি হবে।

তবে এই চালান যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির আওতায় পড়বে কিনা, তা নিয়ে অস্থিরতা রয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে টিম গ্রুপের এমডি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘শুল্ক নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও বর্তমানে আমাদের অর্ডার বুকিং ভালোই আছে।’ তিনি আরও জানান, চীন ও ভিয়েতনামের ওপর উচ্চ শুল্কের কারণে বাংলাদেশের রফতানি বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এক খুচরা বিক্রেতা ইতোমধ্যেই তার কারখানায় পরিদর্শনে এসে চীনের পরিবর্তে বাংলাদেশ থেকে অর্ডার দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে প্যাসিফিক জিন্সের এমডি সৈয়দ এম তানভীর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বড়দিনের মৌসুম সামনে রেখে এখনও অর্ডার আসছে। তবে শুল্ক যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে ভবিষ্যতের চালান প্রভাবিত হতে পারে।’

 

ইউরোপে বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ইইউতে বাংলাদেশের রফতানি হয়েছে ১৫.০৭ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট পোশাক রফতানির প্রায় অর্ধেক (৪৯.৮২ শতাংশ)। এই অঞ্চলের শীর্ষ আমদানিকারক হচ্ছে জার্মানি (৩.৮ বিলিয়ন ডলার), এরপর রয়েছে স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও পোল্যান্ড। বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩.১৫ শতাংশ, যা উল্লেখযোগ্য।

 

যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য বাজার

বিজিএমইএ’র তথ্য বলছে, যুক্তরাজ্যেও রফতানি বেড়েছে, যদিও হার তুলনামূলকভাবে কম— মাত্র ৪.১৪ শতাংশ। অন্যান্য বাজার যেমন- জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতেও রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬.৬৬ শতাংশ।

Manual2 Ad Code

 

সামনের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

উদ্যোক্তাদের বলছেন, চলতি বছরের বাকি সময়েও বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে ইতিবাচক প্রবণতা বজায় থাকার আশা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে ক্রেতারা বিকল্প বাজার হিসেবে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন, ফলে নতুন কার্যাদেশ আসার সম্ভাবনাও বাড়ছে।

তবে প্রতিযোগিতা, শুল্কনীতি পরিবর্তন এবং ইউরোপের বাজারে চাহিদা কমার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকারের নীতি সহায়তা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি টেকসই করা সম্ভব। এজন্য নতুন বাজারে প্রবেশ ও পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি জরুরি। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘এখন প্রয়োজন মান বজায় রেখে বহুমুখী বাজারে প্রবেশ এবং রাজনৈতিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় কৌশলী হওয়া।’

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশের ৯০০টির বেশি কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করছে, এর মধ্যে ২৫টির প্রধান বাজার আমেরিকা। চীন ও ভিয়েতনামের পর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়, বাজার শেয়ার ৯.৩ শতাংশ। বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাকের আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশাল বাজার বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করছে।

Manual4 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code