প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ইসলামি ব্যাংকগুলো একীভূত করার প্রস্তাব: সমাধান নাকি নতুন সংকট?

editor
প্রকাশিত মে ৫, ২০২৫, ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ
ইসলামি ব্যাংকগুলো একীভূত করার প্রস্তাব: সমাধান নাকি নতুন সংকট?

Manual8 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

দেশের ইসলামি ব্যাংকিং খাত সম্প্রসারণের মাঝে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের এক মন্তব্য নতুন আলোচনা সৃষ্টি করেছে। তিনি জানিয়েছেন, সরকার দেশের ১০টি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করে দুটি বড় ইসলামি ব্যাংক গঠন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। তার এই বক্তব্যে সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের উদ্যোগ নিলে তা কি সমস্যার উত্তরণ ঘটাবে, নাকি নতুন করে সংকট সৃষ্টি করবে?

বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত আমানতের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা এবং মোট বিনিয়োগ ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যদিও ইসলামি ব্যাংকিং ধারাবাহিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে কিছু ব্যাংক সুশাসনের অভাবে সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের প্রভাব বলয়ে থাকা ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রক পরিবারের সদস্যদের এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে অপসারণ করে। এরপর এখনও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে রয়েছে।

Manual8 Ad Code

এমন প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স-২০২৫’ অনুমোদন দিয়েছে, যার আওতায় আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর অবসায়ন অথবা মার্জার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, সব ব্যাংক একত্রিত করে দুটি বড় ইসলামি ব্যাংক গঠন করা বাস্তবসম্মত হতে পারে না। অন্তত তিনটি ইসলামি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর মতে, কিছু নির্দিষ্ট ব্যাংকের মধ্যে একীভূতকরণ সম্ভব হতে পারে, তবে একযোগে ১০টি ব্যাংক একত্রিত করার প্রক্রিয়া ব্যাংক খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, ‘ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর চেয়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনা এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা বেশি জরুরি। শুধু একীভূতকরণ করলেই কাঙ্ক্ষিত সুফল আসবে না।’

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিনও মন্তব্য করেন, ‘দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আগে টিকে থাকার মতো সক্ষম করে তুলতে হবে। তারপর একীভূতকরণ কার্যকর হতে পারে।’

Manual7 Ad Code

বর্তমানে বেশিরভাগ ইসলামি ব্যাংক আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পদের মান যাচাইয়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং জনপ্রিয় হলেও সুশাসনের ঘাটতি এবং কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংক খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। একীভূতকরণের উদ্যোগ কেবল তখনই কার্যকর হতে পারে—যখন তা আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।

 

গভর্নর যা বলেছিলেন

গত ৯ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, ‘বর্তমানে দেশে একাধিক ছোট ও সমস্যাগ্রস্ত ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। তাদের একীভূত করে দুটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত ব্যাংক গঠন করা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা আইন ও তদারকি কাঠামো গড়ে তোলা হবে এবং আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসরণ করে এই খাতকে একটি নতুন রূপ দেওয়া হবে।’

Manual7 Ad Code

 

ব্যাংকিং খাতের সংকট এবং একীভূতকরণের পরিকল্পনা

বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং খেলাপি ঋণের কারণে অনেক ব্যাংক বিপদে পড়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা এখন অত্যন্ত সংকটাপন্ন। এই পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ব্যাংক নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না এবং তাদের তারল্য সংকটের কারণে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে চলতে হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মন্তব্য করেছেন, ‘ব্যাংক মার্জার একটি বিকল্প, তবে এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সময় দিতে হবে।’

 

একীভূতকরণের সম্ভাব্য ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

বিশ্বব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে যে পরিকল্পনা তৈরি করেছে, তা কেবল তখনই কার্যকর হবে, যখন ব্যাংকগুলোকে সুশাসনের আওতায় এনে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো যাবে। বর্তমানে দেশের ইসলামি ব্যাংক খাত সংকটে রয়েছে, বিশেষ করে বেসরকারি ইসলামি ব্যাংকগুলো ঋণ কেলেঙ্কারি এবং অনিয়মের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং আন্তর্জাতিক পর্যালোচনার মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তবে একীভূতকরণের পরবর্তী ধাপ সফল হতে হলে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা, সুশাসন এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

তবে বর্তমানে একীভূতকরণের পরিকল্পনা সফল হওয়ার জন্য আরও সময় প্রয়োজন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে এটি ব্যাংক খাতে নতুন সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ‘ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপেক্ষার অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান।

তিনি বলেন, ‘ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে আমরা আপাতত কোনও কার্যক্রম শুরু করছি না। আমরা অপেক্ষা করছি ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির জন্য। এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হলে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’

উল্লেখ্য, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে এবং দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি ক্ষমতা দিতে ইতোমধ্যে ‘ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলে শিগগিরই এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে।

Manual2 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code