প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ঋণের চাপে ছোট হচ্ছে বাজেট, উন্নয়নে বরাদ্দ ৪ বছরে সর্বনিম্ন

editor
প্রকাশিত মে ১২, ২০২৫, ০৭:৩২ পূর্বাহ্ণ
ঋণের চাপে ছোট হচ্ছে বাজেট, উন্নয়নে বরাদ্দ ৪ বছরে সর্বনিম্ন

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী, সংকোচনমূলক বাজেট প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতা থেকে সরে এসে বাজেটের আকার কমিয়ে ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা— চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। বাজেট ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২ জুন।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাজেট সংকোচনের প্রধান কারণ হচ্ছে— অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর সুদ পরিশোধে ব্যয়ের বড় ধরনের বৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরে সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা আগামী অর্থবছরে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় ১৬.৮ শতাংশ, যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য।

এই চাপ মোকাবিলায় উন্নয়ন খাতে ব্যয় সংকোচন করা হচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রস্তাবিত আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। এটি গত চার অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অপরদিকে, পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের তুলনায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।

Manual6 Ad Code

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘এটি শুধু একটি রুটিন বাজেট নয়। এটি হবে কাঠামোগত সংস্কারের জন্য একটি রূপরেখা, যা পরবর্তী সরকারের জন্য ভিত্তি তৈরি করবে।’

এই সংস্কার প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ঘাটতি কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো। এ জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) নীতি ও প্রশাসনের পৃথকীকরণ, ভ্যাট কাঠামোর সমন্বয় এবং কর অব্যাহতি হ্রাসসহ একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

 

রাজস্ব আহরণ ও সংস্কারের চ্যালেঞ্জ

নতুন অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলার লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) নীতি ও প্রশাসনের পৃথকীকরণ, কর অব্যাহতি হ্রাস এবং ভ্যাট কাঠামোর আধুনিকায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এনবিআরের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা—চলতি বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭.৬ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে মাত্র ৭.৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের সর্বনিম্ন। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই হারকে ‘গভীর কাঠামোগত দুর্বলতা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে কর অব্যাহতি হ্রাস, ইউনিফর্ম ভ্যাট হার প্রবর্তন ও শুল্ক কাঠামো সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।

 

বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দে ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পরিকল্পনা

২০২৫-২৬ অর্থবছরে দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রস্তাবিত আকার হতে যাচ্ছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা—যা গত চার অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ১৪ শতাংশ কাটা হচ্ছে উন্নয়ন বরাদ্দ। এ সংকোচনের নেপথ্যে আছে বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব আহরণের দুর্বলতা এবং বাস্তবায়ন-অকার্যকারিতার বাস্তবতা।

 

এডিপি বাস্তবায়নে ভরাডুবি

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার মাত্র ৩৬.৬৫ শতাংশ, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় না হওয়ায় সরকারের সক্ষমতা ও জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, ‘উন্নয়ন ব্যয়ের সক্ষমতা না থাকলে বাজেট সংকোচনই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত।’ তার মতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া বড় প্রকল্পগুলো দ্রুত আর্থিক সুফল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, বরং বরাদ্দের অকার্যকারিতা প্রকট হয়ে উঠছে।

Manual4 Ad Code

 

সীমিত সম্পদে কৌশলী ব্যয় পরিকল্পনা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বারবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। এবারের বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি সহায়তা থেকে ৮৬ হাজার কোটি টাকা জোগাড়ের পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

Manual5 Ad Code

রাজস্ব ঘাটতি ও বৈদেশিক সহায়তার সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই এবার আরও রক্ষণশীল বাজেট প্রণয়নের দিকে যাচ্ছে সরকার। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর (এসওই) নিজস্ব প্রকল্পে খরচও কমিয়ে আনা হয়েছে ১৩,২৮৯ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৮,০০০ কোটিতে।

 

সামাজিক সুরক্ষা ও অগ্রাধিকার খাত

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এবারের বাজেটে প্রকল্প নির্বাচন হবে ‘অগ্রাধিকারভিত্তিক’। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) উভয় প্রতিষ্ঠানই সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, ইউনিয়ন পর্যায়ে অনুদান স্থগিত থাকায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিপদে পড়েছে।

পিআরআই-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, ‘এখন নমনীয় বাজেটের সুযোগ নেই। বরং আরও বেশি শৃঙ্খলিত ও লক্ষ্যভিত্তিক ব্যয়ের কাঠামো দরকার।’

 

সংস্কার বাস্তবায়ন ও আইএমএফের কর্মসূচি

অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে ব্যাংক খাতের উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা থাকবে বলে জানা গেছে।

তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচি নিয়ে। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইএমএফের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন থাকুক বা না থাকুক, সরকার কাঠামোগত সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আগামী ১৮ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অনুমোদনের কথা রয়েছে। ২০২৫-২৬ সালের বাজেট হতে চলেছে একদিকে সীমিত সম্পদের কৌশলী ব্যবস্থাপনা, অপরদিকে রাজস্ব আহরণ ও বাস্তবায়ন সক্ষমতার কঠিন পরীক্ষার মঞ্চ। বাজেট পরিকল্পনা যতই নিখুঁত হোক না কেন, বাস্তবায়ন দক্ষতা না থাকলে তা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে—সেটিই এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেট প্রণয়নের বিভিন্ন ধাপে জনসম্পৃক্ততা অত্যন্ত সীমিত।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিগত দিনে দেখা গেছে বাজেটের ত্রুটি নিয়ে সংসদে আলোচনা খুব কম হয়েছে। আবার যারা বাস্তবায়ন করবে, তাদের মতামতও নেওয়া হয় না। প্রতি বছর বাজেট বড় করে ঐতিহাসিক উপাধি দিয়ে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপ (আইবিপি) পরিচালিত ওপেন বাজেট সার্ভের (ওবিএস) তথ্যমতে, বাজেট নিয়ে গঠনমূলক জনআলোচনার সুযোগ তৈরিতে সরকার প্রয়োজনীয় তথ্যাদি প্রকাশ করে না। ফলে করদাতাদের অর্থ প্রকৃত অর্থে জনকল্যাণে ব্যয় হচ্ছে কিনা, তা জানার সুযোগ সীমিত থেকে যায়। ওপেন বাজেট সার্ভের তথ্য অনুযায়ী বাজেট স্বচ্ছতার দিক থেকে বাংলাদেশ ১২৫টি দেশের মধ্যে ৩৭তম অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি পাকিস্তানের চেয়ে একটু এগিয়ে থাকলেও শ্রীলঙ্কার সমান অবস্থানে রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাজেট প্রস্তুতির বিভিন্ন স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। সংসদ ও মহা-হিসাব নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের তদারকিও খুব দুর্বল। বিশ্বব্যাপী গড় স্বচ্ছতা স্কোর যেখানে ৪৫, সেখানে বাংলাদেশের স্কোর তারও নিচে।

উল্লেখ্য, ৬১ বা ততধিক স্কোর পাওয়া দেশগুলোকে স্বচ্ছ বাজেট চর্চাকারী বলা হয়, যারা জনগণের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করে।

বাংলাদেশে বাজেটের পূর্ব প্রস্তুতিমূলক একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘পূর্ব-বাজেট বিবৃতি’ প্রকাশ করা হয় না। বিশ্বের অনেক দেশ এই বিবৃতি প্রকাশ করে, যাতে রাজস্ব, ব্যয় এবং ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে জনমত গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসির পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, ‘করদাতারা কীভাবে তাদের অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা জানার অধিকার রাখেন। বাজেট পর্যবেক্ষণ করা হলে টাকার সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বাজেটের আগে অনেক আলোচনা দেখি, কিন্তু সেসব পরামর্শ বাস্তব বাজেটে কতটা প্রতিফলিত হয় তা জানা যায় না।’

Manual2 Ad Code

‘পাবলিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৯’ অনুযায়ী প্রতি ত্রৈমাসিকে বাজেট বাস্তবায়ন প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন বাধ্যতামূলক। বাস্তবায়নের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয় দিলেও তা যথাসময়ে প্রকাশ করা হয় না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘পাবলিক মানি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী সংসদে প্রতিবেদন পেশ করাও অনেকটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার থাকলেও বাজেট প্রণয়নে পরামর্শমূলক প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code