প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

নাছিমার লাল শাড়ি আঁকড়ে এখনো কাঁদেন মা

editor
প্রকাশিত জুলাই ২৪, ২০২৫, ০১:০২ অপরাহ্ণ
নাছিমার লাল শাড়ি আঁকড়ে এখনো কাঁদেন মা

Manual1 Ad Code

নোয়াখালী প্রতিনিধি:
একটি লাল জামদানি শাড়ি—যেটা ছিল নাছিমা আক্তারের (২৪) প্রিয়। সেই শাড়িতে বউ সাজতেন আর তুলতেন অসংখ্য ছবি। আজ সেই শাড়িই তার মায়ের কাছে স্মৃতি। শোকের প্রতীক হয়ে উঠেছে সেই শাড়ি। মেয়ের শেষ স্মৃতিচিহ্নটি আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদেন মা ছালেহা বেগম।

নাছিমা আক্তার নোয়াখালীর সুধারাম মডেল থানার মাইজদী বাজার এলাকার মৃত ইউছুপ মিয়ার মেয়ে। তিনি স্বল্প সময়ের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলেন ঢাকায়। তার বিয়ের আলাপ চলছিল। তার ইচ্ছা ছিল চার বোন মিলে একই রঙের শাড়ি পরে বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। পুরো বাড়িতে আলোকসজ্জা হবে। কিন্তু সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল। মেহেদী রাঙানো হলো না নাছিমার।

Manual2 Ad Code

জানা গেছে, ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে, রাজধানীর ধানমন্ডি ১ নম্বর সড়কের একটি ১০ তলা ভবনের ছাদে। সেখানে নাছিমা ও তার ভাতিজা আইমান উদ্দিন (২৩) অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ করেই আকাশে একটি হেলিকপ্টার ও ড্রোন ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরই ছাদে থাকা দুইজনই গুলিবিদ্ধ হন। একটি গুলি আইমানের বুক ভেদ করে পাশে থাকা নাছিমার মুখে প্রবেশ করে এবং গলায় আটকে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় তাৎক্ষণিকভাবে আহত দুইজনকে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের ভর্তি করা হয়। পরদিন বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় নাছিমা আক্তারের।

Manual6 Ad Code

নাছিমার ভাবি ও গুলিবিদ্ধ আইমানের মা রেহানা বলেন, আমি বাসায় ছিলাম। আইমান তার ফুফুসহ ছাদে দেখতে যায়। গুলিবর্ষণের ঘটনার খবর শুনেই আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি—চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করি। চারপাশের মানুষ ছুটে আসে, তারপর তাদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকরা তখন বলছিলেন, আমার ছেলে ও ননদ বাঁচবে না। মুহূর্তেই যেন সব অন্ধকার হয়ে আসে আমার সামনে। চারদিকে তখন ইন্টারনেট বন্ধ, কোথাও যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমি একা, পুরোপুরি অসহায়। অনেক চেষ্টা, দোয়া ও ডাক্তারদের চেষ্টায় আমার ছেলেকে শেষমেশ বাঁচানো গেল—কিন্তু আমার ননদকে আর ফিরিয়ে আনা গেল না। সেই ক্ষত কোনো দিন মুছে যাবে না।

Manual1 Ad Code

কান্নাভেজা কণ্ঠে নাছিমার বোন কোহিনুর বেগম বলেন, নাছিমা খুব ভালোবাসতো সাজতে। লাল জামদানি শাড়ি তার প্রিয় ছিল—পরত, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত। তার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, সে নিজেই বলেছিল— বিয়েতে পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমল করবে, আমরা সব বোন একই রঙের শাড়ি পরবো। কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এখনো বিশ্বাস করতে পারি না সে নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে। আবার পুরো বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজি— কিন্তু ওকে আর পাই না। আমার বোনকে যারা এমন নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে, আমরা তাদের কঠিন শাস্তি চাই। আমার বোনের প্রাণের যেন মূল্য থাকে।

নাছিমার ভাই হেলাল উদ্দিন সোলায়মান বলেন, আমি স্পেন প্রবাসী। তখন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি নাছিমাকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়, যেখানে এক রাত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পরদিন বিকেলে শহীদ হয় নাছিমা। আমার ছেলে আইমান ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। পরে ৫ আগস্ট ছাড়পত্র পেয়ে বাসায় ফেরে। তার বুকে এখনো গুলির ক্ষত রয়েছে। মানসিক ট্রমা রয়ে গেছে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাছিমার মা ছালেহা বেগম বলেন, আমার সাত সন্তানের মধ্যে নাছিমা ছিল সবার ছোট। চার মেয়ের মধ্যে সে আমার শেষ আশ্রয়, আমার চোখের মনি। সব সময় আমার কাছেই থাকতো, আমি বলতাম—ওই তো আমার হাতের লাঠি।

Manual1 Ad Code

নাছিমা সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকত। বাচ্চাদের ভীষণ ভালোবাসত, আর আশপাশের বাচ্চারাও ওকে খুব পছন্দ করত। কিছুদিনের জন্য ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল আমার সোনা মেয়েটা। কে জানতো, সে আর ফিরবে না। লাশ হয়ে ফিরেছে আমার বুক ভেঙে। ওর শাড়িগুলো, সাজসজ্জার জিনিসগুলো—সবই এখন স্মৃতি হয়ে আছে আমার সামনে। ওর লাল টুকটুকে জামদানি শাড়ি দেখলেই বুক হাহাকার করে ওঠে, চোখ ভিজে যায়। আমি আল্লাহর কাছে শুধু এই দোয়া করি—আমার মেয়েকে যেন জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে রাখেন।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code