প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

বিয়ানীবাজারে ভাঙছে পারিবারিক বন্ধন

editor
প্রকাশিত মে ১৫, ২০২৫, ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ
বিয়ানীবাজারে ভাঙছে পারিবারিক বন্ধন

 

হাফিজুর রহমান তামিম:

 

একটি সমাজের মৌলিক কাঠামো গড়ে ওঠে পরিবারকে কেন্দ্র করে। পরিবার শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, এটি এক আত্মিক বন্ধন, যেখানে ভালোবাসা, ত্যাগ, সহানুভূতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বিরাজ করে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, বিয়ানীবাজারের সমাজব্যবস্থায় সেই সম্পর্কগুলোর মধ্যেই দেখা দিচ্ছে ফাটল। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রবাসীবহুল বিয়ানীবাজারে পারিবারিক বন্ধনের ব্যাপক অবক্ষয় হয়েছে। একইসাথে সামাজিক সম্প্রীতিও হ্রাস পাচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভাই-ভাইকে হত্যা, ছেলে হয়ে মাকে নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতাসহ নানা ঘটনা নাড়া দিচ্ছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, কিসের অভাবে নিজ পরিবারের সদস্যদের কাছে অপর সদস্য নিগ্রহের শিকার হচ্ছে।

বিয়ানীবাজারের মুড়িয়া ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে সম্প্রতি আপন ভাই-ভাতিজাদের হামলায় একরাম আলী (৫৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এর আগে দক্ষিণ দুবাগ গ্রামে আদিল হোসেন (২৫) নামে এক যুবককে মাথায় আঘাত করে খুন করেন আব্দুল কাদির মিয়া (২৯) নামে তার আপন ভাই। গত বছরের ৯ অক্টোবর এ ঘটনা ঘটে।

 

বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সন্তানদের পড়াশোনা বা কাজের জন্য বিদেশযাত্রা, পিতার দীর্ঘদিন প্রবাসে অবস্থান, প্রযুক্তির আগ্রাসন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। একে একে ভেঙে যাচ্ছে বহু পরিবার। অথচ একসময় দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-ফুপু-মামা নিয়ে এক যৌথ পরিবার গড়ে উঠত স্থানীয় সমাজব্যবস্থায়। কিন্তু এই যৌথ পরিবারে বিশ্বাসী সমাজই আজ একক পরিবারে হয়েও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এতে বাবা-মা-সন্তান নিজ নিজ জায়গায় সবাই একা হয়ে পড়ছেন।

 

বিয়ানীবাজারে যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখা বহু পরিবার এখন ভেঙ্গে গেছে। বহু বছর ধরে যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখা সত্তরোর্ধ্ব জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমার পরিবারে আমার ছয় ভাই ও এক বোন। আমরা বহু বছর যৌথ পরিবারে ছিলাম। এখনো আমাদের পরিবারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের মতামতই গুরুত্ব পায়। আমি তাদের বড় ভাই। কাজের কারণে ভাইয়েরা এখন আর একসঙ্গে থাকে না। গত ৪ বছর থেকে আমাদের সেই পরিবার পৃথক হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, যৌথভাবে থাকতে গেলে নিজেদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ আর স্যাক্রিফাইস করার মন থাকতে হয়। একে অন্যকে মানতে হয়। এটি যেমন নিজেকে সংযত হতে শেখায়, তেমন অনেক ভুল পথে যাওয়া থেকেও আমাদের বাঁচায়। যেকোনো বিপদ-আপদে আমরা একে অন্যকে পাশে পাই, যা এখন বেশির ভাগ পরিবারে দেখা যায় না।’

বরং এর উল্টো চিত্রই সমাজে বাড়ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের নাইমা ও তার স্বামী শরিফুল ইসলাম দম্পতি তাদের একমাত্র সন্তানকে লেখাপড়ার জন্য ২০১০ সালে কানাডা পাঠান। লেখাপড়া শেষে তাদের ছেলে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তারা মাঝে মাঝে সন্তানকে দেখতে যান। কিছুদিন কানাডা থাকেন আবার দেশে চলে আসেন। আর সন্তান না থাকায় শরিফুল দম্পতি এখন একাই থাকেন পৌরশহরের নিজস্ব বাসায়।

নাইমা আক্তার বলেন, ‘পরিকল্পনা ছিল ছেলে দেশে ফিরে আসবে। আমরা দেশেই থাকব। কিন্তু ছেলের পড়াশোনা শেষ হতে হতে সে ওখানেই ভালো চাকরি পেয়ে গেছে। স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগও হয়েছে। উন্নত একটি দেশে এমন সুযোগ হওয়ায় আমরা তো আর তাকে না করতে পারি না। সন্তানকে মিস করলেও এভাবেই বাকি জীবন কাটাতে হবে। কারণ দেশে কাছে বা দূরে হলেও অনেক আত্মীয়স্বজন আছে, আমরা তাই দেশের মায়াও ছাড়তে পারি না।’

 

বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজের প্রভাষক সঞ্জয় আচার্য বলেন, পারিবারিক বন্ধন ভাঙার পেছনের মূল কারণ হলো পরিবারের সদস্যদের ব্যস্ত জীবনধারা ও সময়ের সংকট, প্রযুক্তির প্রভাব ও ভার্চুয়াল আসক্তি, অর্থকেন্দ্রিক সমাজ ও ভোগবাদিতার বিস্তার, যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে রূপান্তর এবং প্রজন্মগত মানসিক ফারাক। তিনি বলেন, ‘ত্যাগ, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গা দখল করছে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। অনেক সময় আর্থিক অসচ্ছলতা বা সম্পত্তিগত দ্বন্দ্ব পরিবার ভাঙনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক সময় এগুলো তাদের হিংস্রও করে তুলছে। আগে আমাদের সমাজে দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ভাই-ভাতিজাসহ বড় পরিবারে সবাই মিলেমিশে বসবাস করতেন। এখন পারস্পরিক সহায়তা বা আলাপের জায়গা কমে গেছে, বেড়েছে একাকিত্ব ও দায়িত্বের চাপ।’

বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মিলাদ মো. জয়নুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় সন্ধ্যার পর পুরো পরিবার একসঙ্গে গল্প-গুজব করে সময় কাটাত। এখন সেই সময় দখল করে নিয়েছে মোবাইল, ট্যাব ও টেলিভিশন। একসঙ্গে বসে থেকেও একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ কমছে। মা-বাবা ফোনে ব্যস্ত, সন্তান ভিডিও গেমে মগ্ন- এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে সম্পর্কের দেয়াল। এতে সন্তানদের মনে কী চলছে বা তারা কতটুকু সামাজিক হয়ে বড় হচ্ছে, তা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। এতে তাদের সঙ্গে মা-বাবার কেবল দেনা-পাওনার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। পারিবারিক বন্ধনের জায়গাটা হালকা হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য তারা জীবনের অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা চিন্তা করছেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনা, জীবনধারা এবং মূল্যবোধ অনেকটাই আলাদা। মা-বাবা ও সন্তানের মাঝে প্রায়ই দেখা দেয় মতবিরোধ, যা একসময় দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। পারিবারিক বন্ধনের অভাব এই দূরত্বকে আরও গভীর করে তোলে। তাই সন্তানের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো প্রয়োজন।’

পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধিসহ বিয়ানীবাজারের সমাজ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে নানা সমস্যা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট সমস্যা হচ্ছে শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হওয়া ও তরুণ প্রজন্ম হয়ে পড়ছে হতাশাগ্রস্ত ও আত্মকেন্দ্রিক হওয়া। বাড়ছে দাম্পত্য কলহ ও বিচ্ছেদ। সমাজে একাকিত্ব, বিষণ্ণতা, অবসাদ ও আত্মহত্যার হার বাড়ছে। এ ছাড়া সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় বৃদ্ধ মা-বাবারা হয়ে পড়ছেন একা। অনেকের সন্তান পড়াশোনাসহ কাজের জন্য বিদেশে চলে যাওয়ায় তারা দেশে বা গ্রামে একা রয়ে যাচ্ছেন।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আলী আহমদ বলেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো, একসঙ্গে খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি সম্পর্ক দৃঢ় করতে পারে। তাই সময় করে পরিবারের সদস্যদের এক হতে হবে। পরিবারের সঙ্গে ভার্চুয়াল নয়, বাস্তব সংযোগ গড়তে হবে। ছোট বয়স থেকেই শিশুদের মধ্যে পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য পরিবার ও বিদ্যালয়ে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাঠ্যবইয়ে পারিবারিক সম্পর্ক ও দায়িত্ব সম্পর্কে বেশি বেশি শেখাতে হবে। সম্ভব হলে একাধিক প্রজন্মের পরিবারে বসবাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও মানসিক বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। নিজেদের মধ্যে দাম্পত্য সমস্যা বা সন্তানের সঙ্গে পারিবারিক টানাপোড়েন মেটাতে পেশাদার কাউন্সেলিং গ্রহণে সামাজিক স্বীকৃতি বাড়ানো জরুরি।

Sharing is caring!