
প্রজন্ম ডেস্ক:
সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ইতিমধ্যে মতামত জমা দিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, সিপিবিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কমিশনের সংশ্লিষ্টরা জানান, সব দল বা ক্ষেত্রবিশেষে অধিকাংশ দল যেসব সংস্কার সুপারিশে একমত হবে সেগুলো নিয়েই প্রণয়ন করা হবে ‘জাতীয় সনদ’। এটি হবে রাষ্ট্রকে নতুন ধারায় পরিচালনার একটি গাইডলাইন বা নীতিমালা। এর সাংবিধানিক কোনো ভিত্তি না থাকলেও এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অঙ্গীকার চাইবে ঐকমত্য কমিশন। আগামী জুলাইয়ের মধ্যেই এটি চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। চূড়ান্ত হওয়ার পর এটি জমা দেওয়া হবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় সনদের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের দিনক্ষণ। ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ রয়েছে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। তাই জুলাই মাসে জাতীয় সনদ চূড়ান্ত হলে ডিসেম্বরেই নির্বাচন করা সম্ভব হবে। তবে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ইস্যুতে কমিশনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি ও নবগঠিত এনসিপির পরস্পরবিরোধী মতামতের কারণে কিছুটা বিপাকে পড়েছে ঐকমত্য কমিশন। এ কারণে বিএনপির সঙ্গে বারবার দীর্ঘ সময় ধরে বৈঠক করতে হচ্ছে কমিশনকে। সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল সেগুলোর অধিকাংশের সঙ্গেই এনসিপি একমত হয়েছে।
তবে সংবিধানের বেশিরভাগ মৌলিক পরিবর্তনের প্রস্তাবে বিরোধিতা করেছে বিএনপি। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন—সংবিধান সংস্কার কমিশনের এ সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়নি দলটি। তারা চাইছে একই ব্যক্তি টানা দুবারের পর বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। গত রোববার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়ে বিএনপি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
এ সময় বৈঠকে কমিশনের পক্ষ থেকে ‘এক ব্যক্তি মাঝখানে বিরতি দিয়ে সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন’ নতুন এই প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে নতুন এ প্রস্তাবের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। কমিশনকে তারা জানিয়েছে, এ বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদে আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত জানাবে। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে প্রায় সব প্রস্তাবে বিএনপি একমত হলেও ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ১৯৭১ সাল এবং ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনার বিষয়ে বিএনপি ভিন্নমত পোষণ করেছে।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবেও একমত হয়নি দলটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পরবর্তী সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক বলে মত দিয়েছে। তারা বলেছে, যদি একটি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তৈরি হয় এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হয়, তা হলে বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয়প্রধান হতে পারবেন না সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন সুপারিশের সঙ্গেও একমত হয়নি বিএনপি। বিএনপি বলেছে, একটি দলের প্রধান কে হবেন, তারা ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, কে সংসদ নেতা হবেন—এসব ঠিক করার বিষয়টি একান্ত দলের নিজস্ব বিষয়। এসব সংবিধানে ঠিক করে দেওয়া যাবে না।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে। আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্যদের প্রত্যেকের একটি করে ভোট, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট (৬৪টি জেলা সমন্বয় কাউন্সিল থাকলে ৬৪টি ভোট), সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট দেবে। কমিশনের এ প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি।
কমিশন সূত্র জানায়, বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যেমন একমত হয়েছে তেমনি বিপরীতধর্মী মতামতও এসেছে। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়ার পাশাপাশি সংবিধানে সাম্য, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নয় দলটি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার বলেন, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখা তৈরি হয়েছিল। তবে সেটা এত ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হয়নি। তিনি বলেন, দেশে এত বড় ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান আগে কখনো হয়নি। ব্যাপকভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগও আগে কখনো হয়নি। জাতীয় সনদ তৈরির উদ্যোগও দেশে এই প্রথম। এটি হচ্ছে রাষ্ট্রকে নতুন ধারায় পরিচালনার একটি গাইডলাইন বা নীতিমালা তৈরি করা। ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অঙ্গীকার।
জাতীয় সনদে কী কী থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করছে। ইতিমধ্যে দলগুলো তাদের লিখিত মতামতও দিয়েছে। সব দল বা ক্ষেত্রবিশেষ অধিকাংশ দল যেসব সুপারিশের বিষয়ে একমত হবে সেগুলো একত্রিত করে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা হবে। যেসব সুপারিশের বিষয়ে দলগুলোর আংশিক একমত সে বিষয়গুলো নিয়ে দ্বিতীয় বা প্রয়োজনে তৃতীয় দফায় তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জাতীয় সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে জানতে চাইলে মনির হায়দার বলেন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও আলোচনা হবে। এটি বাস্তবায়নে দলগুলোর কাছ থেকে অঙ্গীকার আদায় করা হবে। জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একাধিক ভাগ থাকবে। যেমন কিছু থাকবে আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে। আবার কিছু বিষয় রয়েছে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে করতে হবে। সংবিধান সংশোধন গণপরিষদের মাধ্যমে হবে না কি জাতীয় সংসদের মাধ্যমে হবে এ বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদি সিদ্ধান্ত হয় সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন হবে তা হলে এ বিষয়ে দলগুলো অঙ্গীকার করবে যে তারা নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদে এগুলো পাস করবে।
গণপরিষদ গঠনের প্রয়োজন হলে সেখানেও পাস করবে। তবে যে সুপারিশগুলো আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। বাকিগুলো রেখে দেওয়া হবে সংসদের জন্য।
সুপ্রিমকোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, সংবিধান সংশোধন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে হবে। তা না হলে কোনো সংস্কারের সুপারিশই কার্যকর হবে না। যারা আগামী নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসবেন তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। তারা বাস্তবায়ন না করলে জনগণের অর্থের অপচয় হবে এবং কমিশনের শ্রম পণ্ড হবে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন—১৯৯০ সালের অস্থায়ী সরকারের প্রধান বিচাপতি সাহাবুদ্দিনের সরকার ২৮টি সংস্কার কমিশন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আসা নির্বাচিত সরকার তেমন কোনো সুপারিশই বাস্তবায়ন করেনি। একইভাবে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ১২২টি অধ্যাদেশ করেছিল; কিন্তু পরবর্তীকালে নির্বাচিত সরকার মাত্র ৪৬টি আইনে পরিণত করেছিল। বাকি ৭৮টি অধ্যাদেশ আইনে পরিণত করেনি। ফলে এ ৭৮টি অধ্যাদেশ প্রণয়ন পণ্ডশ্রম ও অর্থের অপচয় ছিল। তাই যে সংস্কারই করা হোক তা অর্থবহ করতে হবে এবং নির্বাচিত সরকার যদি সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে তা হলে পণ্ডশ্রম হবে কমিশনগুলোর কার্যক্রম।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সুনির্দিষ্ট পথ খুঁজে বের করে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে সবাই মিলে চেষ্টা করছেন। তারা জাতির আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে যত দ্রুততার সঙ্গে সম্ভব একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে চান। তিনি বলেন, এ কমিশনের মেয়াদ জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তাই আশা করছি প্রাথমিক আলোচনা মে মাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে শেষ করা যাবে। এরপর পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হবে কমিশন। বিবেচনা করা হবে কীভাবে এক জায়গায় আসা যায়।
আলী রীয়াজ বলেন, কিছু কিছু সুপারিশের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে সামান্য ভিন্নতা আছে। আলোচনার মাধ্যমে এ মতভিন্নতা দূর করা সম্ভব হবে। যে ঐক্যের মাধ্যমে একটা ফ্যাসিবাদী শাসনকে পরাস্ত করতে পেরেছি, সেই ঐক্যের জায়গাকে অব্যাহত রেখে তা আরও সুদৃঢ় করতে পারব বলে আশাবাদী।
Sharing is caring!